মরক্কোর রূপকথা থামিয়ে ফ্রান্স ফাইনালে
থেমে গেছে মরক্কো রূপকথা। কাতার বিশ্বকাপে মরক্কো রূপকথার জন্ম দিয়ে আফ্রিকার প্রথম দেশ হিসেবে সেমি ফাইনালে উঠে জন্ম দিয়েছিল রূপকথার। সেই রূপকথায় আরও রং লাগানোর দৃপ্ত ইচ্ছে ছিল মরক্কানদের। কিন্তু তাদের আর নতুন করে রূপকথা লেখার সুযোগ দেয়নি ফ্রান্স। মরক্কোকে থামিয়ে নিজেরা নতুন রেকর্ডের ভাগিদার হয়ে উঠে গেছে ফাইনালে। জিতেছে ২-০ গোলে। গোল করেন হার্নান্দেজ ও রান্দেল। বিশ্বকাপ ফুটবলে ইটালি (১৯৩৪ ও ১৯৩৮), ব্রাজিল (১৯৫৮ ও ১৯৬২), নেদারল্যান্ডস (১৯৭৪ ও ১৯৭৮), আর্জেন্টিনা (১৯৮৬ ও ১৯৯০) পরপর দুবার ফাইনাল খেলেছিলো। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স এবার ফাইনালে উঠে সে রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছে। তবে পরপর তিনবার ফাইনাল খেলার রেকর্ড আছে জার্মানির। তারা ১৯৮২, ১৯৮৬ ও ১৯৯০ সালে ফাইনাল খেলেছিলো। একই রেকর্ড আছে ব্রাজিলের ঝুলিতেও। তারা ১৯৯৪, ১৯৯৮ ও ২০০২ সালে ফাইনাল খেলেছিলো।
এটি ফ্রান্সের চতুর্থবার ফাইনাল উঠা। ১৮ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় রাত ৯ টায় লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে ফ্রান্স শিরোপা ধরে রাখার মিশনে মুখোমুখি হবে মেসির আর্জেন্টিনার। প্রথম সেমিতে আর্জেন্টিনা মেসির যাদুতে বর্তমান রানার্সআপ ক্রোয়শিয়াকে ৩-০ গোল বিধ্বস্ত করেছিল। ২০০২ সালের পর আবার ল্যাথিন আমেরিকা ও ইউরোপের ফাইনাল খেলা হবে। ২০০২ সালে সর্বশেষ ফাইনাল খেলেছিল ব্রাজিল ও জামার্নি। ব্রাজিল জিতেছিল ২-০ গোলে। এরপর চারটি আসরের ফাইনাল হয়েছে ইউরোপের দুই দেশের মাঝে।
দ্বিতীয় সেমিফাইনালে লড়াই ছিল ফ্রান্সের আক্রমণ ভাগ বনাম মরক্কোর রক্ষণভাগ। ফ্রান্সের আক্রমণ ভাগ যেমন যেকোনো দলের জন্য ভীতিকর, তেমনি মরক্কোর রক্ষণ যে কোন দলের জন্য টেনশনের কারণ। অবশ্য মরক্কোর রক্ষণ ফ্রান্সের ভয়ঙ্কর আক্রমণ ভাগের সামনে খুব বেশি সময় টেনশনের কারণ হয়ে উঠতে পারেনি খেলা শুরু হতে না হতেই পাঁচ মিনিটের মাথায় গোল দিয়ে এগিয়ে যায় ফ্রান্স। ডান দিক দিয়ে গড়ে উঠা আক্রমণ মরক্কোর শক্তিশালী রক্ষণকে ফাঁকি দিয়ে বল ঢুকে যায় ভিতরে। সেই বল ধরে বক্সের ভিতর থেকে গ্রিজম্যান পাস দেন এমবাপেকে। বক্সের ভেতর থেকে এমবাপের বাম পায়ের শট মরক্কোর গোলরক্ষক বোঝো ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিরিয়ে দিলেও কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সামনে থাকা হার্নান্দেজ বাম পায়ে ভলি শটে গোল করেন। ১৯৫৮ সালের পর বিশ্বকাপ ফুটবলের সেমিফাইনালে এটি ছিল দ্রুততম গোল। সেবার ফ্রান্সের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ব্রাজিলের হয়ে দ্বিতীয় মিনিটে গোল করেছিলেন ভাভা। খেলায় ব্রাজিল জয়ী হয়েছিল ৫-২ গোলে। এবারের বিশ্বকাপে মরক্কো প্রথম গোল হজম করে পিছিয়ে পড়ে।
৯ মিনিটে মরক্কোর গোল পরিশোধের সুযোগ নষ্ট করে দেন ফ্রান্সের গোলরক্ষক লরিস। প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে ওনাইয়ের ডান পায়ের শট লরিস বাম দিকে জাপিয়ে পড়ে রক্ষা করেন। ১৬ মিনিটে বক্সে ঢুকে জিরোডের বাম পায়ে শট সাইডবারে লেগে ফিরে ফিরে আসে। ৩৫ মিনিটে প্রথমে এমবাপে পরে জিরোড ফাঁকা পোস্টে গোল করতে ব্যর্থ হন। টিচোয়ামেনি বক্সের ভিতর এমবাপেকে ফাঁকায় বল ঠেলে দিয়েছিলেন। মরক্কোর রক্ষণভাগের একজন খেলোয়াড়ের বাধা সত্বেও এমবাপে ডান পায়ের শটে গোলরক্ষককে বোনোকে ঠিকই পরাস্ত করেছিলেন। কিন্তু গোলে প্রবেশের আগে আশরাফ হাকিমি ক্লিয়ার করেন। বল আবার চলে আসে বক্সে। এসময় জিরোডের শট সাইডবার দিয়ে বাইরে চলে গেলে ফ্রান্স গোল বঞ্চিত হয় ।
৪৪ মিনিটে ভাগ্য সহায়তা না করায় মরক্কো গোল পরিশোধ করতে পারেনি। কর্ণার কিক থেকে ইয়ামিকের বাইসাইকেল শট সাইডবারে লাগে ফিরে আসলে মরক্কো নিশ্চিত গোল বঞ্চিত হয়।
দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু হলে মরক্কো চেপে ধরে ফ্রান্সকে। একের পর এক আক্রমণ রচনা করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলে ফ্রান্সের রক্ষণ। কখনো মরক্কোর খেলোয়াড়ার সুযোগ নষ্ট করেছেন, কখনো ফ্রান্সের খেলোয়াড় নষ্ট করে দিয়েছেন। এ সময় বল দখলে ছিল তাদের বেশি। মরক্কোর আক্রমণ সামাল দিয়ে ফ্রান্সও গোল বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। তেমনই একটি সুযোগ ছিল ৭১ মিনিটে গ্রিজম্যানের ফ্রি কিক থেকে। মার্কোস থুরামের হেড বার ঘেষে বাইরে চলে যায়। ৭৫ মিনিটে বক্সে ঢুকেও শট নিতে দেরি করাতে মরক্কো গোল করার সুযোগ হারায়। বক্সে ঢুকে বদলি হামাদাল্লাহ ফ্রান্সের রক্ষণের একজন খেলোয়াড়কে ডজ দিয়ে অনেকটা ফাঁকায় বামপায়ে শট নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি আরও সুবিধাজনক জায়গা খুঁজতে গিয়ে বলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। প্রথম চেষ্টায় শট নিলে একটা কিছু হতে পারতো। কারণ এ সময় তার সামনে শুধু গোলরক্ষক ছিলেন। এই ভুলের মাসুল দেয় মরক্কো ৭৯ মিনিটে দ্বিতীয় গোল হজম করে। একটি পরিকল্পিত আক্রমণ থেকে এমবাপে মরক্কোর রক্ষণ তছনছ করে বল বাড়িয়ে দেন ফাঁকায় থাকা বদলি খেলোয়াড় রান্দেল কোলো মুআনিকে। এমবাপে যে এভাবে বল বাড়িয়ে দেবেন, তা বুঝতে পারেনি মরক্কোর রক্ষণের খেলোয়াড়রা। যে কারণে রান্দেলের সামনে একজন খেলোয়াড় থাকার পরও তিনি শুরুতে দৌড়াননি। যখন দৌড় দিয়েছেন, ততক্ষনে রান্দেলে বলের পজিশনে চলে গিয়েছেন। সেখান থেকে তার গোল না করার কোনও কারণই ছিল না। এটি ছিল তার প্রথম আর্ন্তজাতিক গোল।
এ দিন ভাগ্য সত্যিকার অর্থে মরক্কোর দিক থেকে মুখ তুলে নিয়েছিল। ইনজুরির টাইমের তৃতীয় মিনিটে ওনাইয়ের ডান পায়ের ভলি শট গোলে প্রবেশের মুখে গোললাইন থেকে কাউন্ডেনিশ্চিত গোল রক্ষা করেন। গোলটি পেলেও মরক্কো স্বান্তনার সুযোগ পেত।
এমপি/এএস