ভারতের দম্ভচূর্ণ, বাংলাদেশের সিরিজ জয়
বিশ্বকাপ ফুটবলের ডামাঢোলে যেখানে অন্য সব খেলা আড়ালে পড়ে যায়। সেখানে টাইগারদের গর্জনে জেগে উঠেছে ক্রিকেট। 'বাংলাদেশ, বাংলাদেশ' জয়ধ্বনিতে মুখরিত মিরপুরের হোম অব ক্রিকেট। টাইগারদের গর্জনে কুপোকাত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তারকা সমৃদ্ধ দল ভারত। দ্বিতীয় একদিনের ম্যাচে ভারতকে ৫ রানে হারিয়ে বাংলাদেশ জিতে নিয়েছে একদিনের সিরিজ।
টস জিতে প্রথম ম্যাচের জয়ের নায়ক মেহেদি হাসার মিরাজের অপরাজিত প্রথম সেঞ্চুরিতে ভর করে বাংলাদেশ ৭ উইকেটে ২৭১ রান করে। জবাব দিতে নেমে ভারত করে ৯ উইকেটে ২৬৬। এই জয়ের মাধ্যমে ফিরিয়ে এনেছে ২০১৫ সাল। তখন ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর ভারত বাংলাদেশ খেলতে এসে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ হেরে বাংলাদেশের কাছে প্রথমবারের মতো সিরিজ হেরেছিল।
এবার ভারত বাংলাদেশে খেলতে আসে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর। প্রথম ম্যাচে টানটান উত্তেজনার পর এক রানে বাংলাদেশ ম্যাচ জিতে সিরিজে এগিয়ে গিয়েছিল। বুধবার (৭ ডিসেম্বর) সিরিজ জয় নিশ্চিত করে নিজেদের কাছে রেখে দেয়। এটি ছিল ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের দ্বিতীয় আর সব মিলিয়ে ৩২তম সিরিজ জয়। তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের তৃতীয় ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে ১০ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে। ম্যাচ সেরা হয়েছেন অপরাজিত ১০০ রান ও বল হাতে ৪৬ রানে ২ উইকেট নিয়ে প্রথম ম্যাচের মতো মেহেদি হাসান মিরাজ।
একটা সময় মনে হয়েছিল বাংলাদেশ সহজেই জিতবে। কারণ ১০ ওভারে ৩৯ রানে ছিল না ভারতের ৩ উইকেট। বিরাট কোহলি, শেখর ধাওয়ান, ওয়াশিংটন সুন্দর ফিরে যান। শ্রেয়াস আইয়ারের ৮২ ও অক্ষর প্যাটেলের ৫২ রানে ম্যাচে ফিরে ভারত। এই দুইজনের বিদায়ের পর ভারতের প্রয়োজন ছিল ৭০ বলে ৮৩ রানের। উইকেট মাত্র ৪টি। সেখান থেকে ভারত শেষ বল পর্যন্ত জয়ের সম্ভাবনা তৈরি করেছিল।
আর এটি সম্ভব হয়েছিল অধিনায়ক রোহিত শর্মার কারণে। নিয়মিত ওপেন করা এই ওপেনারের ইনজুরি ভারতের জন্য কল্যাণ বয়েই এনেছিল প্রায়। তিনি যখন ক্রিজে আসেন, তখন ভারতের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ৩ উইকেটে ৪৪ বলে ৬৪ রানের। এই ৪৪ বলের ২৮ বল খেলে রোহিত মরা ম্যাচকে চাঙা করে তুলেন। তার আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে কোন দিক দিয়ে যে ক্যারিয়ারের ৪৬তম হাফ সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন সে দিকে কারও ভ্রুক্ষেপই ছিল না। সবার দৃষ্টি তখন ম্যাচে। ৪৮ ওভার পর্যন্ত ম্যাচ ছিল বাংলাদেশের দিকে। তখন ভারতের প্রয়োজন ৪০ রানের।
বাংলাদেশের জয় অনেকটা নিশ্চিত। কিন্তু মাহমুদউল্লাহর করা সেই ওভারে রোহিত দুই ছক্কা আর এক চারে ২০ রান নিলে শেষ ওভারে প্রয়োজন পড়ে ২০ রানের। মাহমুদউল্লাহর ওভারে রোহিত দুবার জীবন পান। একবার এবাদত, আরেকবার এনামুল হক বিজয় ক্যাচ ফেলেন। এবাদতের ক্যাচ কিছুটা কঠিন হলেও এনামুলের হাতে সরাসরি ক্যাচ গিয়েছিল। ভারত ম্যাচ জিতলে এই ক্যাচ ফেলে দেওয়াটা তখন খুব বড় করে সামনে চলে আসত। যেমনটি প্রথম ম্যাচে মিরাজের ক্যাচ ফেলে তার মাশুল দিয়েছিল ভারত ম্যাচ হেরে। সেই ওভারে শেষ পর্যন্ত মাহমুদউল্লাহ উইকেট পান। তবে রোহিতের নয়, মোহাম্মদ সিরাজের দ্বিতীয়বার জীবন পাওয়ার সময় রোহিত এক রান নিয়েছিলেন। সেটি ছিল ওভারের পঞ্চম বল। শেষ বল সিরাজ খেলতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান।
শেষ ওভার করতে আসেন মোস্তাফিজ। স্ট্রাইকে রোহিত শর্মা। প্রথম বলে কোনো রান নিতে না পারলে গোটা মিরপুর স্টেডিয়াম হর্ষধ্বনি করে উঠে। কিন্তু পরের দুই বলে বাউন্ডারি হাঁকালে নীরবতা নেমে আসে স্টেডিয়ামে। এসময় অনেককেই দুই হাত তুলে প্রার্থনা করতে দেখা যায়। পরের বলে কোনো রান নিতে না পারলে কিছুটা স্বস্তি নেমে আসে। ফলে শেষ দুই বলে প্রয়োজন পড়ে ১২ রানের। পঞ্চম বলে রোহিত শর্মা ছক্কা হাঁকালে শেষ বলে চলে আসে সেই চরম নাটকীয়তা। অধিনায়ক লিটনের সঙ্গে কিছুটা পরামর্শ করে একটু সময় নিয়ে মোস্তাফিজ বল করতে আসেন। ছোড়েন নিজের সেরা অস্ত্রের একটি ইয়র্কার। ব্যাটে-বলে সঠিকভাবে সংযোগ ঘটাতে ব্যর্থ হন রোহিত। এক রান নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি রান না নিয়ে সোজা ড্রেসিংরুমের দিকে হাঁটা ধরেন। বিপরীতে বাংলাদেশ শিবিরে তখন সিরিজ জয়ের উল্লাস।
বিশ্ব ক্রিকেটে ভারতের ব্যাটিং লাইন খুবই শক্তিশালী। তাদের কাছে তিনশ রানও নিরাপদ নয়। কিন্তু এবার সেই বিশ্ব সেরা ব্যাটিং লাইনকে বাংলাদেশের বোলাররা বোতলবন্দী করেছেন। প্রথম ম্যাচে তাদের মাত্র ১৮৬ রানে আটকে রাখা হয়েছিল। আজ বাংলাদেশ যখন ৭ উইকেটে ২৭১ রান করে, তখন মিরপুরের উইকেট বিবেচনায় বাংলাদেশের জয় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়। বাকি ছিল উইকেটে বোলারদের কাজটা সেরে নেওয়া। সেই কাজটি তারা করেছেন নিখুঁতভাবে।
২৭১ রান মজবুত পুঁজি। সেই পুঁজিকে আরও বেশি মজবুত করে তুলতে দরকার ছিল শুরুতেই আঘাত হানা। সেই কাজটি সুচারুভাবে পালন করেন বাংলাদেশের বোলাররা। আক্রমণ শুরু করেন অধিনায়ক স্পিন দিয়ে। অপরপ্রান্তে পেস। এতেই বাজিমাত বাংলাদেশের। এবাদত তার প্রথম ওভারে বিরাট কোহলিকে (৫) বোল্ড করে বাঘের মতো গর্জন করতে থাকেন। সঙ্গে অন্যরাও। তৃতীয় ওভারে মেহেদিকে না এনে লিটন মোস্তাফিজকে আক্রমণে এনে সফলতার মুখ দেখেন যখন শেখর ধাওয়ান (৮) ফিরে যান মিরাজের হাতে ক্যাচ দিয়ে।
১০ ওভারের মাঝে বাংলাদেশ আরও একটি উইকেট তুলে নেন। সাকিব বল হাতে নিয়েই ওয়াশিংটন সুন্দরকে (১১) আউট করেন মিরাজ ক্যাচ নিলে। লুকেশ রাহুলও ফিরেন ১৪ রান করে মিরাজ এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেললে। এরপর গড়ে উঠে শ্রেয়াস ও অক্ষরের জুটি। যে জুটিতে তারা ১৬.৩ ওভারে যোগ করেন ১০৭ রান। ১৭ রানের ব্যবধানে প্রথমে শ্রেয়াস ও পরে অক্ষর ফিরে গেলে ভারত আবার চাপে পড়ে। শ্রেয়াসকে মিরাজ-আফিফের সহায়তায় এবং অক্ষরকে সাকিবের সহায়তায় এবাদত আউট করেন। শার্দুল ঠাকুর ৭ রান করে ফিরে যাওয়ার পর দৃশ্যপটে আসেন রোহিত শর্মা। সৃষ্টি হয় চরম নাটকীয়তা। বাংলাদেশ সহজকে করে তুলে কঠিন। এবাদত ৪৬ রানে ৩টি এবং সাকিব ৩৯ ও মিরাজ ৪৬ রানে নেন ২টি করে উইকেট।
এমপি/এসজি