মেলবোর্নে শেষ হাসির অপেক্ষায় পাকিস্তান-ইংল্যান্ড
একটি আসরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ফাইনাল ম্যাচ। ফাইনাল মানেই উত্তেজনায় ভরপুর। একটি মনকাড়া ম্যাচ। কিন্তু ক্রিকেটের ক্ষেত্রে যেন এর ব্যতিক্রম। বড্ড বেশি ভারত কেন্দ্রিক! আইসিসির যেকোনো আসর মানেই যেন ফাইনালের এক পাশে ভারত থাকা। তা না হলে যেন ফাইনালের ‘মসলা’ ঠিকমতো হয় না। নিরামিষ ‘ভুরিভোজ’ হয়ে পড়ে।
ক্রিকেট বিশ্বেও বিষয়টি অনেকটা ওপেন সিক্রেট হয়ে গেছে। আইসিসিও যেন চায় ভারত অন্তত ফাইনাল খেলুক। না হলে ক্রিকেট মার্কেটিং অনেক ক্ষতির মুখে পড়ে। গত কয়েক আসরের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের এবারের আসরেও ভারত ফাইনালে উঠতে পারেনি। কাজেই মেলবোর্নের এক লাখ ধারণ ক্ষমতার স্টেডিয়ামে পাকিস্তান-ইংল্যান্ডের ফাইনাল যেন অনেকটা নিরামিষ ভুরিভোজের মতোই আগামীকাল (১৩ নভেম্বর) রবিবার অনুষ্ঠিত হবে।
ফাইনালকে কেন্দ্র করে মেলবোর্ন প্রস্তুত হচ্ছে। কিন্তু সেখানে যেন কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। বিয়ের বাড়ির সাজ মনে হচ্ছে না। ভারত থাকলে সেখানে অন্যরকম আবহ থাকত। কিন্তু আইসিসি ফাইনালের আগেই ম্যাচের উত্তাপ সৃষ্টি আয়োজন করেছে দুই দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে সমর্থকদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে। এসময় দুই দলের সমর্থকদের, বিশেষ করে পাকিস্তানের সমর্থকদের বেশ উৎফুল্ল দেখা গেছে। এসবই কিন্তু ম্যাচের আগের আবহ। ফাইনাল ম্যাচ শুরু হওয়ার পর তা হারিয়ে যায়। দুই দলই অবতীর্ণ হয় শিরোপা যুদ্ধে। তাদের কাছে ভারত ফাইনালে আছে কি নেই সেটার কোনো গুরুত্ব থাকে না।
ফাইনালও অনেক সময় হয়ে উঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভরপুর। যেমনটি হয়েছিল ২০১৯ সালে ইংল্যান্ড ও নিউ জিল্যান্ডের ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে। যেটিকে বলা হয়ে থাকে আইসিসিরি সেরা ফাইনাল। ইংল্যান্ড ও পাকিস্তানের কাছেও এরকম একটি ফাইনাল সবাই প্রত্যাশা করছেন। ভারত না থাকলেও এক লাখ দর্শক ধারণ ক্ষমতার মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড ভরে উঠবে। তবে সেখানে বাধ সাধতে পারে ক্রিকেটের আজন্ম শত্রু বৃষ্টি।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী, বজ্রসহ মুষলধারে বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে সারাদিন। ম্যাচ মাঠে গড়াতে না পারলে সেক্ষেত্রে পরের দিন সোমবার রিজার্ভ ডেতে চলে যাবে খেলা। সোমবারও বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে। বৃষ্টির কারণে পুরো খেলা না হলেও অন্তত ১০ ওভার খেলা আয়োজনের চেষ্টা করবে আইসিসি। কাট আউট টাইম রাখা হয়েছে দুই ঘণ্টা।
দুই দলই যেভাবে সেমিতে প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিয়ে ফাইনালে উঠে এসেছে তাতে করে জমজমাট একটি ফাইনাল দেখার অপেক্ষায় আছে ক্রিকেট বিশ্ব। অথচ দুই দলই ছিল দুই গ্রুপের রানার্সআপ। পাকিস্তান যেভাবে নিউ জিল্যান্ডকে আর ইংল্যান্ড ভারতকে ‘বধ’ করেছে দুটি সেমি ফাইনাল এরকম এক পেশে হবে, তা ছিল সবার ভাবনার অতীত। পাকিস্তান ও ইংল্যান্ডকে এভাবে অনায়াসে ফাইনালে তোলার কারিগর ছিলেন দুই দলের উদ্বোধনী জুটি। দুই দলের সামনেই কিন্তু টার্গেট কম ছিল না। পাকিস্তানকে ১৫২ রানের টার্গেট দিয়েছিল নিউ জিল্যান্ড। ইংল্যান্ডের সামনে ভারতের ছুড়ে দেওয়া টার্গেট ছিল আরও বেশি, ১৬৮। কিন্তু পাকিস্তানের মোহাম্মদ রিজওয়ান ও অধিনায়ক বাবর আজম এবং ইংল্যান্ডের অ্যালেক্স হেলস ও অধিনায়ক জস বাটলার ‘খুনি’ হয়ে উঠেছিলেন। দ্বিতীয় সেমিতে ইংল্যান্ড ১০ উইকেটে জয়ী হলেও প্রথম সেমিতে পাকিস্তানও ছিল সেই পথেই। কিন্তু ১০৫ রানে গিয়ে ভেঙে গিয়েছিল জুটি অধিনায়ক বাবর আজম আউট হওয়ায়। পরে তারা আরও ২ উইকেট হারিয়ে ম্যাচ জিতেছিল ৭ উইকেটে।
মেলবোর্নে ফাইনাল ম্যাচ মঞ্চস্থ হওয়ার আগে খুব বেশি করে সামনে চলে এসেছে ১৯৯২ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের স্মৃতি। এই মেলবোর্নেই মঞ্চস্থ হয়েছিল পাকিস্তান ও ইংল্যান্ডের বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম কোনো ফাইনাল। যেখানে ইমরানের খানের পাকিস্তান জয়ী হয়েছিল ২২ রানে। ২০১৫ সালেও কিন্তু ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনাল হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ডের মাঝে এই মেলবোর্নেই। ৭ উইকেটে ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু ১৯৯২ সালের ফাইনাল ফিরে আসার কারণ ঘটনা প্রবাহ।
একে তো একই প্রতিপক্ষ। দ্বিতীয়ত পাকিস্তানের ফাইনালে উঠে আসার গল্প। সেবার তারা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সেমিতে উঠে এসে পরে বিশ্ব জয় করেছিল। এবারও অনেকটা তাই। প্রথম দুই ম্যাচ হেরে যাত্রা শুরু করা পাকিস্তানের সেমিতেই আসার কথা ছিল না। কিন্তু নেদারল্যান্ডসের মতো পুচকে দলের কাছে দক্ষিণ আফ্রিকা, যারা জিতলেই চলে যেত সেমিতে, সেখানে তারা হেরে বসে। আর দুয়ার খুলে গিয়েছিল পাকিস্তানের। সঙ্গে বাংলাদেশেরও। দুই দলের অলিখিত কোয়ার্টার ফাইনালে ৫ উইকেটে বাংলাদেশকে হারিয়ে পাকিস্তান আজ শিরোপা জেতার শেষ ধাপে।
পাকিস্তানের মতো ইংল্যান্ডের সেমিতে আসার রাস্তা এতটা কণ্টকাকীর্ণ ছিল না। শেষ ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে তারা টিকিট নিশ্চিত করেছিল। তাদের বিজয়ে বিদায় ঘণ্টা বেজেছিল স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার। অনেকেই ১৯৯২ সালের ফাইনাল মঞ্চয়ানের পুনরাবৃত্তি দেখছেন। তবে এসবই গাণিতিক হিসেব। ফাইনালে এর কোনো মূল্যই নেই। পাকিস্তানের অধিনায়ক বাবর আজম আজ কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ব্যাপারে প্রচণ্ড রকমের আত্মবিশ্বসাী।
শনিবার (১২ নভেম্বর) তিনি ম্যাচ পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমরা প্রথম দুই ম্যাচ হারলেও পরের ৪ ম্যাচ জিতে এ পর্যায়ে এসেছি। আমাদের এ ঘুরে দাঁড়ানো ফাইনালের আগে আমাদের আত্মবিশ্বাস যোগাচ্ছে। ফাইনালে আমরা এই ছন্দ ধরে রাখতে চাই। ভক্তদের মুখে হাসি ফোটাতে চাই।
অন্যদিকে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক জস বাটলার পাকিস্তানকে খুবই শক্তিশালী দল হিসেবে উল্লেখ করলেও ফাইনালে নিজেদের সেরা খেলাটা খেলতে চান। তিনি বলেন, তারা (পাকিস্তান) চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সামর্থ্য রাখে। এমন একটি দলের বিপক্ষে খেলা খুবই চ্যালেঞ্জিং। আগেও আমরা তাদের বিপক্ষে বেশ কিছু ম্যাচ ভালো খেলেছি। আশা করি ফাইনালে আমরা আমাদের সেরাটা দিতে পারব।
দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়ে অনেক এগিয়ে ইংল্যান্ড। পাকিস্তানের জয়ের দ্বিগুণ তাদের জয়। ২৮ বারের মোকাবিলায় ইংল্যান্ড জয়ী হয়েছে ১৮ বার। পাকিস্তান জিতেছে ৯ বার। একবার ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছিল। আবার দুই দলের সর্বশেষ দ্বি-পাক্ষিক সিরিজেও শেষ হাসি হেসেছিল ইংল্যান্ড। সাত ম্যাচের সিরিজে লড়াইও হয়েছিল দারুণ। শেষ দুই ম্যাচ জিতে ইংল্যান্ড সিরিজ জিতে নিয়েছিল ৪-৩ ব্যবধানে।
আসরে ব্যক্তিগতভাবে দৃষ্টি ফেরালে ব্যাটিংয়ে দেখা যায় সেমি ফাইনালে বিজয়ী দুই দলের উদ্বোধনী জুটিই আশার বাতি। পাঁচ ম্যাচের সবকটিতে ব্যাট করে অ্যালেক্স হেলস ২১১ ও জস বাটলার ১৯৯ রান করেছেন। আর কোনো ব্যাটসম্যান তিন অঙ্কের ঘরে যেতে পারেননি। এখানে আবার পাকিস্তান কিছুটা এগিয়ে। তিন অঙ্কের ঘরে রান করা ব্যাটসম্যানের তালিকায় নেই অধিনায়ক বাবর আজমের নাম। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ৫৩ রানের ইনিংস খেলে তিনি নিজেকে ফিরে পেয়েছেন। এটি দলের জন্য একটি ভালো বার্তা। তার রান ৯২। তিন অঙ্কের ঘরে রান করা তিন ব্যাটসম্যান হলেন- মোহাম্মদ রিজওয়ানের (১৬০) সঙ্গে শান মাসুদ (১৩৭) ও ইফতেখার আহমেদ (১১৪)।
বোলিংয়েও পাকিস্তানের বোলাররা ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে একটু এগিয়ে। পেসার শাহিন শাহ আফ্রিদি ও স্পিনার সাদাব খান দুই জনেই নিয়েছেন ১০টি করে উইকেট। এ ছাড়া দুই পেসার মোহাম্মদ ওয়াসিম ৭টি ও হারিস রউফ ৬টি উইকেট নিয়েছেন। ইংল্যান্ডের হয়ে ১০ উইকেট নিয়েছেন শুধুমাত্র স্যাম কারান। ৯ উইকেট নিয়েছেন মার্ক উড। এ ছাড়া ৫টি করে উইকেট নিয়েছেন বেন স্টোকস ও ক্রিস ওকস।
দুই দলেরই এটি তৃতীয় ফাইনাল। দুই দলের আগের সাফল্যও একই। একবার করে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ। ২০০৭ সালে প্রথম আসরে ফাইনালে উঠে ভারতের কাছে হারের পর ২০০৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আসরে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল পাকিস্তান। ইংল্যান্ড ২০১০ সালে উইন্ডিজে অনুষ্ঠিত আসরে প্রথমবার ফাইনালে উঠেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এরপর ২০১৬ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত আসরে ফাইনালে উঠে হেরে গিয়েছিল উইন্ডিজের কাছে। এবার যে দল চ্যাম্পিয়ন হবে তারা উইন্ডিজের কাতারে চলে যাবে। উইন্ডিজ ২০১২ ও ২০১৬ সালে একমাত্র দল হিসেবে দুইবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
এমপি/এসজি