প্রবাসী ব্রিসবেনবাসীর আনন্দের মাঝেও বেদনা
বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশে দল এক আবেগের নাম। এই আবেগ প্রবাসী বাংলাদেশিদের। যারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন বিশ্বের নানান প্রান্তরে। জীবন সংগ্রামের সঙ্গে লড়াই করতে তারা হয়েছেন আত্মীয় পরিজন ছাড়া। প্রবাসের জীবন কঠিন জীবন। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হয়। রুটিন মাফিক জীবন। সেই রুটিনে কখনো কখনো পরিবর্তন আসে বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের জন্য।
যখনই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দল খেলতে যায় তখন খেলা দেখার জন্য এই সব প্রবাসীদের অনেক ত্যগ স্বীকার করতে হয়। এই ত্যাগ শুধুই প্রিয় বাংলাদেশের জন্য। অনেকেই বাংলাদেশ থেকে লাল-সবুজের জার্সিও আনার ব্যবস্থা করে থাকেন। বাংলাদেশ দলের জার্সি পরে পরিবার-পরিজন নিয়ে মাঠে যাবেন। গলা ফাটিয়ে বাংলাদেশ বাংলাদেশ বলে আওয়াজ তুলবেন। জিতুক আর হারুক অন্তরে বাংলাদেশ এটাই তাদের মূখ্য। এর জন্য যে প্রবাসের একটি ব্যস্ত জীবন উৎসর্গ করে তারা অন্যরকম এক তৃপ্তি পান। সুযোগ পেলে প্রিয় ক্রিকেটারদের একটু কাছে যাওয়া, ছবি তোলা কিংবা অটোগ্রাফ নেওয়ার মাঝেও জড়িয়ে থাকে নিখাদ ভালোবাসা। কিন্তু এসব পেতে গিয়ে প্রবাসীদের কখনো কখনো বঞ্চনা, অবহেলা আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয় প্রবাসীদের। যার সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে ব্রিসবেনে ২২ অক্টোবর বাংলাদেশ দলকে সংবর্ধনা জানাতে গিয়ে।
ব্রিসবেনে বাংলাদেশ দল জয় উপহার দিয়েছে। বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম নাটকীয়তা ভরা ম্যাচ ছিল এটি। ব্রিসবেনে বসবাসরত প্রবাসীরা হয়েছেন এর জীবন্ত সাক্ষী। জয়ের পর তাদের কণ্ঠে ছিল বাঘের গর্জন। ব্রিসবেনে প্রথম খেলতে নেমেই জয়। যদিও ২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি ছিল ব্রিসবেনে প্রথম। কিন্তু বৃষ্টির কারণে ম্যাচটি মাঠেই গড়াতে পারেনি। তাই কাগজে-কলমে এই ম্যাচই প্রথম। এমন জয়ের মাঝেও ব্রিসবনবাসীর অন্তরে কষ্ট থেকে গেছে এবং সেটি থাকবে আরও বহুদিন। ভুক্তভোগীরা হয়তো চাইলেও ভুলতে পারবেন না।
ব্রিসবেনবাসীর এই কষ্টের কারণ বাংলাদেশ দল। বিশেষ করে অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগে বাংলাদেশ দল এখানে খেলেছিল দুইটি প্রস্তুতি ম্যাচ। এই দুই ম্যাচের মাঝেই বাংলাদেশ দলের সম্মানে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ব্রিসবেন। উৎসবের রং লাগিয়ে আয়োজন করতে গিয়ে আয়োজকদের হতে হয়েছে বিব্রত। পড়তে হয়েছে বিড়ম্বনার মুখে। বাংলাদেশ হাইকমিশন ও বিসিবির অনুমতি নিয়েই তারা এই আয়োজন করেছিলেন। বাংলাদেশ দলও সেখানে যথারীতি গিয়েছিল। কিন্তু ক্রিকেটাররা সেখানে আন্তরিক ছিলেন না। বিশেষ করে সাকিব। গিয়েছেন ইচ্ছের বিরুদ্ধে। প্রিয় ক্রিকেটারদের কাছ থেকে দেখতে পেয়ে প্রবাসীদের অন্তরে যখন আনন্দের ঢেউ, সেখানে সাকিব যান্ত্রিক। অন্যরা ব্যাটে অটোগ্রাফ দিলেও সাকিব দেননি।
সব ক্রিকেটারকে হাত ধরে হলরুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন করে ছোট বাচ্চা রাখা হয়েছিল। কিন্তু সাকিব এখানে সহযোগিতা করেননি। অধিনায়ক হিসেবে তাকে দলের পক্ষ থেকে দুইটি কথা বলতে বললে তিনি দুইটি কথাই বলেন, ‘সবাইকে ধন্যবাদ’।
সাকিবের এমন আচরণে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়া আয়োজকদের তখন আর করার কিছুই ছিল না। কিন্তু কেন সাকিব এরকম করলেন তা তারা তাৎক্ষণিক বুঝে উঠতে পারেননি। তাদের অন্তরে কষ্টের আগুন আরও বেড়ে যায়, যখন তারা জানতে পারেন সিডনিতে বিসিবির অনুমতি ছাড়াই সাকিব একটি অনুষ্ঠানে তাসকিনকে নিয়ে গিয়ে প্রাণবন্ত সময় কাটান। পরে তারা জেনেছেন সিডনির অনুষ্ঠানে সাকিব গিয়েছিলেন অর্থের বিনিময়ে। কিন্তু তাদের অনুষ্ঠানে কোনো অর্থ বরাদ্দ ছিল না।
ব্রিসবেনে প্রায় ৩ হাজারের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিদের বসবাস। যারা আছেন তারা সবাই কম বেশি উচ্চ শিক্ষিত। ডাক্তার, প্রকৌশলী অনেক। অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল সরকার ও রাজ্য সরকারের চাকরি করেন অনেকেই। এদের মাঝে যারা সেদিন উপস্থিত ছিলেন তাদের জন্য এটি ছিল বেশ অপমানজনক। শুধুমাত্র দেশের টানে খেলোয়াড়দের ভালোবেসেই তারা সেখানে গিয়েছিলেন। কোনো কিছু পাওয়ার আশায় নয়।
আশরাফ নামে একজন বলেন, ক্রিকেটাররা আমাদের জয় উপহার দিয়েছেন, এটা যে আমাদের জন্যে কতটা আনন্দের, গর্বের তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। কিন্তু সাকিবের ঘটনা মনে হলে খুবই খারাপ লাগে।
সাগর নামে একজন বলেন, আমি যাইনি, শুনেছি। না গিয়ে ভালোই হয়েছে। শুনেই খুব খারাপ লাগছে। গেলে পরে আরও বেশি খারাপ লাগত। তবে এরকম ঘটনা আমরা আশা করি না।
রফিউল আলম রাব্বি বলেন, প্রত্যাশামতো হয়নি। খেলোয়াড়রা আন্তরিক ছিলেন না। ছিলেন মনমরা। আনন্দের ইভেন্টে ছিল না। সবাই যেরকম আশা নিয়ে এসেছিলেন সেরকম হয়নি।
আয়োজক বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ব্রিসবেনের সভাপতি শেখ বাসারউদ্দিন পেশায় প্রকৌশলী। তিনি বলেন, ‘এমন ঘটনায় আমাদের কমিউনিটির সদস্যরা হতাশ হয়েছেন। তবে একটা জায়গায় আমরা সবাই এক। যেখানেই থাকি না কেন, যেকোনো পরিস্থিতি হোক, আমরা সব সময় বাংলাদেশকে সমর্থন করি, বাংলাদেশকে ফলো করি। যেটা হয়েছে সেটা আমরা ভুলে যেতে চাচ্ছি। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল ভালো করবে, আমরা সেই প্রত্যাশায় আছি।’
এমপি/এসজি