এমন ম্যাচের কী হতে পারে শিরোনাম
তিন কাঠির খেলায় নো বল হওয়াটা এমন বিচিত্র কিছু নয়। কখনো কখনো আম্পায়াররা সঙ্গে সঙ্গেই নো বল ডেকে থাকেন। আবার কখনো কখনো থার্ড আম্পায়ারের সহায়তা নিয়ে। কিন্তু আজ বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে ম্যাচে যে নো বল আম্পায়াররা দিয়েছেন, এমন ঘটনা ক্রিকেট বিশ্বে আগে কখনো ঘটেছি কি না তা তাৎক্ষণিকভাবে ঘেঁটে জানা যায়নি।
ম্যাচের শেষ বল। যে বল আবার ছিল ফলাফল নির্ধারণী। জিম্বাবুয়ের জয়ের জন্য প্রয়োজন ৫ রান। বাউন্ডারি হলে স্কোর সমান হবে। ম্যাচ টাই। খেলা গড়াবে সুপার ওভারে। ৫ রান তো আর দৌড়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। ছক্কা ছাড়া বিকল্প নেই। বাংলাদেশকে সেই ছক্কা রুখতে হবে। মোসাদ্দেকের বলে নতুন ব্যাটসম্যান মুজারাবানিকে স্ট্যাম্পিং করেন নুরুল হাসান সোহান। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ শিবিরে শুরু হয় জয়ের উৎসব। দর্শকদের উন্মাতাল আনন্দ। সেখানে থার্ড আম্পায়ারের সহায়তা নিয়ে ফিল্ড আম্পায়ার নো বল কল দেন। মাঠ ছেড়ে যাওয়া দুই দলের খেলোয়াড়রা আবার ফিরে আসেন। হৃদপিণ্ড বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা সবার। কারণ জিম্বাবুয়ের রান কমে হয়েছে ৪। এক বাউন্ডারি হলেই বাংলাদেশের ললাটে আরেকটি হার।
জয়ের উৎসব যেখানে শুরু হয়েছে,সেখানে কি তাহলে হারের বেদনায় মাঠ ছাড়তে হবে। জিম্বাবুয়ের মুঠোয় ম্যাচ। নতুন করে পরিকল্পনা সাজিয়ে অধিনায়ক সাকিব মোসাদ্দেককে সাহস যোগালেন। মোসাদ্দেক তার প্রতিদান দিলেন। কোনো রানই করতে না দিয়ে আবারও স্ট্যাম্পিং করেন মুজারাবানিকে। ৪ রানের জয় নেমে আসে ৩ রানে। এবার অবশ্য বাংলাদেশের খেলোয়াড় থেকে শুরু করে দর্শকরা আর আগের মতো বাঁধন হারা উল্লাস করেননি। খুবই স্বাভাবিক ছিলেন সবাই।
এমন একটি জয়ে শিরোনাম কী হতে পারে? এক ম্যাচে বাংলাদেশের দুই জয়। এক টিকিটে দুই জয়। এমন ম্যাচও ক্রিকেটে হয়। নাকি মোসাদ্দেককে নিয়ে শেষ ওভারে অধিনায়ক সাকিবের জুয়া খেলাকে সামনে এনে মোসাদ্দেককে নিয়ে সাকিবের জুয়া খেলায় বাংলাদেশের জয়। শিরোনাম যেকোনো কিছু হতে পারে। সাব হেড হতে পারে দুইবার আউট হয়েও আউট না মুজারাবানি। কিন্তু এমন ম্যাচও যে তিন কাঠির খেলায় হতে পারে তার প্রদশর্নী দেখল ক্রিকেট বিশ্ব।
শেষ ওভারে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ১৬ রানের। যদি বাংলাদেশ না জিততে পারত তাহলে ভিলেন হতেন কে? মোসাদ্দেক, নুরুল হাসান সোহান, নাকি মোসাদ্দেককে দিয়ে শেষ ওভার করানোর জন্য অধিনায়ক সাকিব? যেহেতু বাংলাদেশ জিতে গেছে, তাই ভিলেন খোঁজা নয়, মোসাদ্দেককে দিয়ে শেষ ওভার করানোর ভেতরের গল্প জানা যাক।
বাংলাদেশ এখন খেলতে নামে একজন বোলার কম নিয়ে। পঞ্চম বোলারের কাজ করানো হয় মোসাদ্দেক, সৌম্য, আফিফকে দিয়ে। কিন্তু আজকের ম্যাচে সাকিব পঞ্চম বোলার হিসেবে মোসাদ্দেকের উপরই আস্থা রাখেন। যদিও আজ সাকিব ও মোসাদ্দেক ভালো বোলিং করতে পারেননি। বিপরীতে পেসাররা আগুন ঝরিয়েছেন। বিশেষ করে দুই পেসার ম্যাচ সেরা তাসকিন ও মোস্তাফিজ। তারপরও সাকিব ১৮ ওভারের মাঝেই তিন পেসারের কোটা শেষ করে ফেলেন। শেষ ২ ওভারের ১৯তম ওভার করেন সাকিব নিজে। শেষ ওভার রেখে দেন মোসাদ্দেকের জন্য।
মোসাদ্দেককে দিয়ে যে শেষ ওভার করানো হবে, তা ১৬তম ওভার শেষেই সাকিব জানিয়ে দিয়েছিলেন। আজ খেলা শেষে ‘মিক্সড’ জোনে এসে সে কথাই জানান মোসাদ্দেক। অধিনায়কের কাছ থেকে এমন বার্তা আগেই পাওয়ায় মোসাদ্দেক নিজেকে সেভাবে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। শেষ ওভারে কী বল করবেন তারও পরিকল্পনা এঁটে ফেলেন অধিনায়কের সঙ্গে পরামর্শ করে।
তিনি বলেন, ‘সাকিব ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল দুই রকম, ইয়র্কার করব নাকি লেন্থ বল করব। মাঠটি সামনের দিক থেকে ছোট ছিল। ইয়র্কার মিস হলে লেন্থ মিস করে ছক্কা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ জন্যই পরিকল্পনা করছিলাম একটু ব্যাক অব লেন্থে, একটু জোরের উপর করব, যেন মিস টাইমিং হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর সাকিব ভাই যে পরিকল্পনা দিয়েছেন, তার বাইরে যাব না।’
সাকিব যে মোসাদ্দেককে নিয়ে জুয়া খেলেছেন, সেই মোসাদ্দেক কিন্তু নিয়মিত বোলার নন। ৩১ ম্যাচ খেলে বোলিং করেছেন ২৬টিতে। যদিও তার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারেতে ২০ রানে ৫ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড আছে। কিন্তু ৪ ওভার বোলিং করার দৃষ্টান্ত আছে আজকের আগে মাত্র তিনটি ম্যাচে। ১ ওভার করে বোলিং করেছেন ১০ ম্যাচে। সেই মোসাদ্দেককে দিয়ে এমন পরিস্থিতিতে শেষ ওভার করানো শুধু জুয়া খেলার মতোই বিরাট ঝুঁকি নেওয়া যায়। যেকোনো প্রতিষ্ঠিত বোলারেরই এমন পরিস্থিতিতে মানসিক চাপ সামাল দিয়ে উঠা কঠিন হয়ে পড়ে। সেখানে যদি অনিয়মিত বোলার হন তাহলে তার মানসিক অবস্থা আরও নাজুক হওয়ারই কথা। কিন্তু মোসাদ্দেকের মানসিক অবস্থা শক্ত ছিল।
তিনি বলেন, ‘ক্রিকেট খেলায় যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। স্নায়ুর চাপের ব্যাপারে সাকিব ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম। উনার সঙ্গে কথা বলার পর আমার চাপ অনেক নিয়ন্ত্রণে ছিল।’
মোসাদ্দেক বলেন, ‘এটা অবশ্যই অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতা সবার জন্যই। তো আসলে যখন আমরা আসলাম আবার ভেতরে গেলাম, সবাই নার্ভটা কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছিল। ঠিক আছে যাই হবে। আমাদের যে প্লান ছিল ওই প্ল্যান অনুযায়ী বোলিং করি, এরপরে যদি তারা নিতে পারে সেট ঠিক আছে। এটা নিয়ে আমরা কোনো চিন্তা করিনি।’
মোসাদ্দেকের টার্গেট ছিল প্রতিটি বলই ডট করার। তিনি বলেন, ‘একটা বলও জেদ দিয়ে করিনি। প্রত্যেকটা বল ডট বল করার জন্য। জেতার জন্য সবার মধ্যে একটা ক্ষুধা ছিল। অবশ্যই সবাই জিততে চাইছে। সেই চেষ্টা এবং শারীরিক অঙ্গভঙ্গি সবাই মাঠে শো করছে। আমি মনে করি যে অবশ্যই পুরো দলের কম্বিনেশন বলেন পুরো টিমের চেষ্টা ছিল আমাদের জেতার পেছনে। সো ফাইনালি জিতেছি।’
এখানে সাকিব আবার প্রশংসা করেছেন মোসাদ্দেকের। ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সাকিব বলেন, ‘মোসাদ্দেকের সঙ্গে আমি এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম। সে আমাকে বলেছিল সে ঠিক আছে। সব সামলে নিবে। তার কথায় আমি আত্মবিশ্বাস পেয়েছি।’
এমপি/এসজি