বাংলাদেশের ‘নাটকীয়’ জয়
ব্রিসবেনের গ্যাবা স্টেডিয়ামের ডিজিটাল বোর্ডে ভেসে উঠছে ‘Bangladesh Win’। বাংলাদেশ ৪ রানে জিতেছে। মাঠের সর্বত্র সেটি চক্রাকারে ঘুরছে। দর্শকরা একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করছেন। জিম্ববুয়ের মতো দলের বিপক্ষে যেখানে জয় আসত হেসে-খেলে, সেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয়ের পর বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। দুই দলের খেলোয়াড়রাও মাঠের বাইরে চলে এসেছেন। জিম্বাবুয়ের শিবিরে ছিল হতাশা। বাংলাদেশের শিবিরে আনন্দ চলছে।
কিন্তু হঠাৎ সেখানে ছন্দপতন। আম্পায়ারা মোসাদ্দেক হোসেনের করা শেষ বলকে নো বল ঘোষণা করেন। সবাই হতবাক হয়ে পড়েন।
টিভি রিপ্লেতে দেখা যায় মোসাদ্দেকের শেষ বলে মুজারেবিনকে স্ট্যাম্পিং করলেও তিনি বল ধরেছিলেন স্ট্যাম্পের সামনে থেকে। যা আইসিসির আইনে নো বল হয়কিছুক্ষন আগে যেখানে বাংলাদেশের দর্শকরা জয়ের আনন্দে মেতে ছিলেন, সেখানে নেমে আসে পিনপতন নিরবতা।
জিম্বাবুয়ের ২ ব্যাটসম্যান আবার ক্রিজে ফিরে যেতে থাকেন। বাংলাদেশের খেলোয়াড়রাও শেষ বল করার জন্য ফিল্ডিংয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
কি হয়, না হয়— এই টেনশনে অনেকেই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেন। কেউ চোখ বুঝে রাখেন। অনেকে মনকে শক্ত করে মোসাদ্দেকের করা শেষ বলটির দিকে এক পলকে চেয়ে থাকেন। নো বল হওয়ার কারণে জিম্বাবুয়ের জয়ের টার্গেট ৫ রান থেকে কমে ৪ রানে নেমে আসে। ফ্রি হিট হওয়াতে জিম্বাবুয়ের জয়ের পাল্লাই ভারী। বোল্ড কিংবা ক্যাচ আউট হওয়ার যখন কোনো সম্ভাবনাই নেই, সেখানে চার কিংবা ছক্কা মারার জন্য মুজারেবিন সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। কিন্তু মোসাদ্দেকের করা বলটি তিনি ব্যাটেই লাগাতে পারেননি। সরাসরি স্ট্যাম্পে আঘাত হানলেও ফ্রি হিট হওয়াকে তিনি আর আউট হননি। বাংলাদেশ ম্যাচ জিতে ৩ রানে।
চলতি আসরে এটি ছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় জয়। প্রথম ম্যাচে তারা নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জয় পেয়েছিল ৯ রানে। ৩ ম্যাচের দুটিতে জিতে ৪ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ এখন সেমি ফাইনালে যাওয়ার লড়াইয়ে শামিল। সমান ম্যাচে জিম্বাবুয়ের পয়েন্টও ৩। সেমিতে যাওয়ার লড়াইয়ে আছে তারাও।
ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের যে সীমাবদ্ধতা তা কিন্তু এই ম্যাচেও ছিল। টস জিতে ব্যাট করতে নেমে ৭ উইকেটে ১৫০ রান করেছিল বাংলাদেশ। প্রথম ওভারেই সৌম্য ফিরে গেলেও নাজমুল হোসেন শান্ত ৫৫ বলে ১ ছক্কা ও ৭ চারে ৭১ রান করার পাশাপাশি লিটন দাস ১২ বলে ১৪, সাকিবের ২০ বলে ২৩ আর আফিফের ১৯ বলে ২৯ রানে আসে বাংলাদেশের এই সংগ্রহ। ইনিংসে বাংলাদেশের ডট বল ছিল ৩৪টি। ২ ছক্কার সঙ্গে বাউন্ডারি ছিল ১২টি।
গ্যাবার উইকেটে এই রান মোটেই নিরাপদ নয়। জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের বোলারদের ক্ষুরধার বোলিং। সেই ক্ষুরধার বোলিংটাই এদিন করে বাংলাদেশ। দুই পেসার তাসকিন আর মোস্তাফিজের শাণিত বোলিংই জিম্বাবুয়েকে কখনই ম্যাচের পরিস্থিতি নিতে দেয়নি। তাসকিন ৪ ওভারে মাত্র ১৯ রান দিয়ে নেন ৩ উইকেট। হন ম্যাচ সেরা। এর আগে তিনি নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা। মোস্তাফিজ ৪ ওভারে ১৫ রান দিয়ে জোড়া আঘাত হেনে নেন ২ উইকেট।
মূলত এই দুই বোলারই বাংলাদেশের জয়ের পথ তৈরি করে দেন। তাসকিনের ১৫টি ও মোস্তাফিজের ১১টি বলে জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানরা কোনো রান নিতে পারেননি। শেষ ওভারের নাটকীয়তায় বোলার মোসাদ্দেকেরও ৪ ওভারে ১১ বলে কোনো রান ছিল না। মোট ৫০ বল ছিল ডট।
১৫০ রানের পূঁজি নিয়ে যেভাবে লড়তে হয়, সে রকম বোলিংই করেছেন এ দিন বাংলাদেশের বোলাররা। তাসকিনে আগের দুই ম্যাচের মতো এই ম্যাচেও প্রথম ওভারে উইকেট এনে দিয়ে বাংলাদেশকে চালকের আসনে বসার কাজটি করে দিয়েছিলেন। পরের ওভারে ফিরিয়ে দেন অধিনায়ক আরভিনকে। তাসকিনের এই ২ উইকেটে জিম্বাবুয়ের উপর যে চাপ তৈরি হয়েছিল, সেখানে মোস্তাফিজ এসে পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে জোড়া আঘাতে হেনে জগদ্দল পাথর চাপিয়ে দেন। তার দুই শিকারের একটি ছিল সিকান্দার রাজার। ব্যাটিং পাওয়ার প্লেতে জিম্বাবুয়ের রান ছিল ৪ উইকেটে ৩৬। এখান থেকে সময় গড়ানোর সঙ্গে জিম্বাবুয়ের রান আর বলের ব্যবধান শুধুই বেড়েছে। পরে সেন উইলিয়ামস রেজিস চাকাভা ও রায়ান বার্লকে নিয়ে একটা চেষ্টা চালিয়েছিলেন। প্রথমে রেজিশ চাকাভাকে নিয়ে। পঞ্চম উইকেট জুটি যখন ক্রমেই পেটমোটা হচ্ছিল জুটিতে ৫.৩ ওভারে ৩৪ রানও যোগ হয়ে যায়, তখনই সাকিব তাসকিনকে আবার আক্রমণে ফিরিয়ে আনেন। তাসকিন তার যোগ্য জবাব দেন জুটি ভেঙে চাকাভাকে আউট করে। তবে এই জুটির চেয়ে সেন উইলিয়ামস ও রায়ান বার্লের জুটি বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল ক্রমেই। ধীরে ধীরে জিম্বাবুয়ে ম্যাচে ফেরার চেষ্টা করছিল। জুটিতে ৭ ওভারে ৬৩ রানও যোগ হয়ে যায়। তাদের এই রানের কারণে শেষ ২ ওভারে জিম্বাবুয়ের প্রয়োজন পড়ে ১৬ রানের। সাকিবের করা ১৯ নম্বর ওভার থেকে ১০ রান এলেও এর মাঝে উইলিয়ামসকে সাকিব রান আউট করেন। এরপর আসে শেষ ওভার।
বাংলাদেশ একজন বোলার কম নিয়ে খেলে। পঞ্চম বোলারের কাজটি করানো হয়ে থাকে মোসাদ্দেক, সৌম্য কিংবা আফিফকে দিয়ে। কিন্তু আজ সাকিব শুধু মোসাদ্দেককেই কাজে লাগান। সাকিবের নিজেরসহ নিয়মিত ৪ বোলারের কোটা শেষ হয়ে যাওয়াতে মোসাদ্দেকের হাতেই বল তুলে দেন সাকিব। প্রথম বলে ১ রান আসলেও পরের বলে মোসাদ্দেক ব্রাড ইভান্সের উইকেট তুলে নেন। নতুন ব্যাটসম্যান এনগ্রাভা এসে প্রথম বলে লেগ বাই থেকে চার ও পরের বলে ছক্কা মেরে ব্যবধান কমিয়ে আনেন ৫ রানে। শেষ ২ বলে জিম্বাবুয়ের প্রয়োজন ৫ রানের। জয়ের পাল্লা তাদের দিকেই ভারী। কিন্তু পঞ্চম বল উইকেট ছেড়ে বের হয়ে এসে খেলতে গিয়ে এনগ্রাভা স্ট্যম্পিং হয়ে যান। নতুন ব্যাটসম্যান মুজারেবিন। তাকে ২ বার আউট করেও মোসাদ্দেক উইকেট পননি। জিম্বাবুয়েকে জিততে হলে মারতে হবে ছক্কা। মুজরেবিন হয়ে যান স্ট্যাম্পিং। যা পরে নো বল হয়। জিম্বাবুয়ের দরকার ৪ রানের। বাউবন্ডারি মারলেই জয় নিশ্চিত। ফ্রি হিটে মুজারেবিন কোনো রান নিতে পারেননি। বাংলাদেশ জিতে যায় ৩ রানে। শেষ হয় চরম নাটকীয়তার ম্যাচ।
এমপি/আরএ/