বিতর্ক আর সাকিব একটি আরেকটির পরিপূরক!
এটি আর নতুন করে কিছু বলার নেই। ২২ গজের সাকিব এক রকম। মাঠের বাইরে আরেক রকম। ২২ গজের সাকিব সবার মধ্যমনি। এটি তিনি অর্জন করে নিয়েছেন নিজের যোগ্যতা দিয়ে। ক্রিকেটার সাকিবের এই গ্রহণযোগ্যতা মানুষের কাছে এতোই বেশি যে কারও কারও কাছে তিনি পরিবারের সদস্যের মতো। অনেকেই তাকে ভালোবেসে বলে ‘বাংলার জান, সাকিব আল হাসান।’ মাঠের ক্রিকেটার বিশ্ব নন্দিত সাকিবকে নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখলেও গুণকীর্তন শেষ করা যাবে না। কিন্তু মাঠের বাইরের সাকিবও কম যান না। তবে তা মানুষের ভালোবাসায় নয়, বিতর্ক আর সমালোচনায়। সাকিব আর বিতর্ক যেন একটি আরেকটির পরিপূরক!
মাঠে নামলে যেমন তিনি রান করতে ভালোবাসেন। উইকেট পেতে পছন্দ করেন। তেমনি মাঠের বাইরে একটার পর একটা বিতর্ক সৃষ্টি করতে তিনি সিদ্ধহস্ত। এই বিতর্কের তালিকায়ও বেশি লম্বা। এর কোনটি তিনি ভুলে বা অজ্ঞাতে বা হিট অব দ্যা মোমেন্টে করলেও অধিকাংশই তিনি করেছেন জেনে-শুনে-বুঝে। এসব করতে গিয়ে তিনি যেমন বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসি কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছেন তেমনি বিসিবি কর্তৃকও। আইসিসিরটা ছিল এক বছরের জন্য। বিসিবিরটা ছিল রকম ফের। কখনো ছয় মাসের জন্য আবার কখনো কয়েকটি ম্যাচের জন্য। কখনো শুধু মৌখিকভাবে সতর্ক বা কারণ দর্শানোর মাঝে।
এসব ক্ষেত্রে সাকিব অধিকাংশ সময় ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে অল্পতেই পার পেয়ে গেছেন। সঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আর কখনো এ জাতীয় কাজ না করার। সাকিব এখানে অবশ্য নিজের কথা রেখেছেন? তিনি একই বিতর্ক বা ভুল আর করেননি। কিন্তু নতুন করে বিতর্ক বা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। যার সর্বশেষ নজির বিশ্বব্যাপী জুয়াড়ি প্রতিষ্ঠান বেটউইনারের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বেটউইনার নিউজের সঙ্গে চুক্তি। এবার সাকিব কোনো সাজা না পেলেও আর এ জাতীয় ভুল না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা কিছুদিন পর সাকিবের নতুন বিতর্ক দেখার! এক নজরে দেখে আসা যাক সাকিবের অতীতের ভুল বা শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনাগুলো।
এক. সাকিব প্রথম সাজা পান ২০১৪ সালে এশিয়া কাপের আসরে মিরপুরে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলা চলাকালীন একটি ম্যাচে তিনি নিজের বিশেষ অঙ্গ অশ্লিলভাবে ইঙ্গিত প্রদশর্ন করেন। যা টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার হয়। এ নিয়ে তুমুল সমালোচনার এক পর্যায়ে তিনি তিন ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন।
দুই. একই বছর বিসিবির অনুমতি না নিয়েই ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ ( সিপিএলে) খেলতে গিয়ে ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন।
তিন. ২০১৫ সালে বিপিএলে রংপুর রাইডার্সের হয়ে সিলেট সুপার র্স্ট্যাসের বিপক্ষে ম্যাচে আম্পায়ার তানভীরের একটি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সীমা লঙ্ঘন করে সাকিব এক ম্যাচে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল ২০ হাজার টাকা জরিমানা।
চার. ২০১৯ সালে আইসিসি থেকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেনর সাকিব । এ ছাড়াও তার ছিল স্থাগিত এক বছরের নিষেধাজ্ঞা। সেই নিষেধাজ্ঞা অবশ্য সাকিবকে পেতে হয়নি আইসিসির নির্দেশনা মেনে এক বছরের সাজা ভোগ করাতে। সাকিব এবার নিষিদ্ধ হয়েছিলেন এক জুয়াড়ির কাছ থেকে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়ে তা গোপন করার অপরাধে। এ সময় বিসিবি সাকিবের পাশে দাঁড়িয়েছিল।
পাঁচ. ২০২১ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে মোহামেডানের হয়ে আবাহনীর বিপক্ষে একটি ম্যাচে আম্পায়ার ইমরান পারভেজের একটি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সাকিব লাথি দিয়ে স্ট্যাম্প ভেঙ্গে ফেলেন। পরে তাকে তিন ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হতে হয়। সঙ্গে ছিল পাঁচ লাখ টাকা জরিমানাও। পরে সাকিব এই ঘটনায় নিজের ফেসবুক পেইজে ক্ষমাও চান।
কৃতকর্মের জন্য সাকিবের সাজা পাওয়ার এসব ঘটনা ছাড়াও দর্শক পিটিয়ে, দর্শকদের সঙ্গে বাজে আচরণ করে, করোনাকালে কোয়ারেন্টাইন না মেনেও বিতর্ক সৃষ্টি করে সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি। চোখ রাখা যাক সেই সব ঘটনাগুলোর দিকে।
এক. ২০১০ সালে সাকিব প্রথম বিতর্কের সৃষ্টি করেন। ভারতের বিপক্ষে সিরিজের একটি ম্যাচ চলাকালে সাইডস্ক্রিনের পাশে এক দর্শকের নড়াচড়াতে তার ব্যাটিং করতে মনযোগ নষ্ট হচ্ছিল। এ কারণে তিনি হঠাৎ ব্যাট উঁচিয়ে বাউন্ডারি লাইনের দিকে গিয়ে সেই দর্শককে শাসান।
দুই. ২০১৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর সিলেটে বিজয় দিবস টি টোয়েন্টি আসরে মোহামেডান ও প্রাইম ব্যাংকের খেলা চলাকালীন সাকিবের কাছে এক দর্শক অটোগ্রাফ চেয়েছিলেন। কিন্তু সাকিব অটোগ্রাফ দিতে রাজি হননি। এতে সেই দর্শক মনের কষ্ট থেকে সাকিবকে উদ্দেশ্য করে কটুক্তি করেছিলেন। তা শুনতে পেরে সাকিব পরে গ্যলারিতে গিয়ে ওই দর্শকের কলার চেপে ধরেছিলেন।
তিন. ২০১৪ সালে সাকিব দুইবার নিষিদ্ধ হওয়া ছাড়াও আরও একটি ঘটনায় দর্শক পিটিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন। ভারতের বিপক্ষে একটি ওয়ানডে ম্যাচের সময় কয়েকজন দর্শক সাকিবের স্ত্রী শিশিরকে উক্ত্যক্ত করার ঘটনা জানতে পেরে সাকিব আইসিসির নিয়ম ভেঙ্গে ড্রেসিং রুম থকে বের হয়ে গিয়ে নিজেই সেই দর্শকদের একজনকে পিটিয়েছিলেন। শুধু মেরেই ক্ষান্ত হননি সাকিব। পরে এই ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কিন্তু আইসিসির নিয়ম ভঙ্গ করে খেলাচলাকালীন ড্রেসিং রুম ত্যাগ করায় সাকিবকে কোনো রকম জবাবদিহি করতে হয়নি!
চার. ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো খেলতে যান সাকিবরা। সে সময় তিনি ছিলেন দলের অধিনায়ক। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ দলকে পেয়ে অতিমাত্রায় উচ্ছাসিত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ছুটে এসেছিলেন উইন্ডিজের বিপক্ষে ফ্লোরিডাতে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ দেখতে। শেষ ম্যাচে সাকিবরা হোটেলে ফেরার আগেই দর্শকদের জটলা হয়ে যায়। লক্ষ্য ছবি তোলা। গাড়ি থেকে নেমে একজন করে ক্রিকেটাররা ঢুকছিলেন। আর দর্শকরা হর্ষধ্বনি দিয়ে উঠছিলেন। যে যেভাবে পারছিলেন খেলোয়াড়দের সঙ্গে ছবি তুলছিলেন। এরই এক পর্যায়ে সাকিব এক দর্শকের দিকে তেড়ে যান। তার এই তেড়ে যাওয়ার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।
পাঁচ. ২০২১ সাল। গোটা বিশ্ব মরণঘাতী করোনার আঘাত ভয়ে তটন্থ। বিশ্বের অনেক অনেক বড় দেশসহ বাংলাদেশেও লকডাউন দেওয়া হয়েছে। বিদেশ যাত্রায় আছে নানান রকম বিধিনিষেধ। আছে দেশে আসার পর বাধ্যতামুলক কোয়ারেনটাইন পিরিয়ড। কিন্তু সাকিব তার থোয়াক্কা করেননি। বিমান যোগাযোগ বন্ধ থাকায় তিনি সড়ক পথে চলে যান ভারতে। বেনাপোল দিয়ে সীমান্ত পার হওয়ার সময় এক ভক্ত তার সঙ্গে সেলফি তুলতে চাইলে সাকিব সেই ভক্তের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলেন।
ছয়. সাকিব ভক্তের মোবাইল ফোন ছুঁড়ে ফেলে বেনাপোল দিয়ে কলকাতা গিয়েছিলেন কালিপূজা উপলক্ষে একটি পূজাপণ্ডবের উদ্বোধন করতে। এটি নিয়েও তুমুল সমালোচনা হয়। মহসিন তালুকদার নামে একজন তার ফেসবুক আইডি থেকে সাকিবকে হত্যার হুমকিও দেন। এই হুমকির ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ফেসবুক লাইভে এসে সাকিব ক্ষমা চান। ফেসবুকে লাইভে তিনি বলেছিলেন, ‘ ঘটনাটি অবশ্যই খুব সেনসিটিভ। আমি বলতে চাই, আমি নিজেকে একজন গর্বিত মুসলমান হিসেবে মনে করি এবং আমি সেটাই চেষ্টা করি মনে করার। ভুল-ত্রুটি হবেই এবং ভুল-ত্রুটি নিয়েই আমরা আসলে জীবনে চলাচল করি। আমার কোনও ভুল হয়ে থাকলে আমি অবশ্যই আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি কিংবা আপনাদের মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে সেজন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’
সাত. ২০২১ সালে বিদেশ থেকে এসে সাকিব জৈব্য সুরক্ষা বলয় মানেননি। তিনি মোহামেডানের হয়ে নেটে ব্যাটিং অনুশীলন করার সময় তাকে বোলিং করেন জৈব্য সুরক্ষা বলয়ে না থাকা এক বোলার। পরে এ ঘটনায় সাকিব ক্ষমা চান। আরেকবার তিনি একইভাবে বিদেশ থেকে এসে কোয়ারেন্টাইন না মেনে একটি প্রতিষ্ঠানের পণ্যের দূত হওয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সমালোচিত হন।
এসব ছাড়াও সাকিব ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অফিসিয়াল ফটোশেসনে দেশে থেকেও মিরপুর এসে চলে গিয়েছিলেন ছবি না তুলেই। এটিও তাকে সমালোচনার কাঠগড়ায় তুলেছিল। আবার কোনো কারণ ছাড়াই ২০১৭ সালে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট সিরিজ খেলতে না যেতে চেয়ে ছয় মাসের ছুটি চেয়েছিলেন। তার এ রকম মানসিকতার জন্যও সমালোচনা হয়েছিল। একইভাবে গত বছর শ্রীলঙ্কা সফরে আইসিসি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিনশিপ না খেলে সাকিব আইপিএল খেলার জন্য ছুটি চেয়েছিলেন। এটিও তাকে বিতর্কের কাঠগড়ায় তুলেছিল। এ ছাড়া জাতীয় দলের হয়ে প্রায় সময় না খেলে ছুটি চাওয়াটাকে সাকিব অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন!
এমপি/এসআইএইচ