মোবাইল ফোনে তৈরী তামিল সিনেমার অ্যাকশন দৃশ্য
তামিল সিনেমার আদলে অ্যাকশন দৃশ্যের ভিডিও তৈরি হয়েছে সাধারণ একটি মোবাইল ফোনের কারসাজিতে। বিস্ময়কর কাজটি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের একদল তরুণ। তাদের দাবি, বাজেট কোনও বড় বিষয় নয়, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে স্বল্প বাজেটে দেশে যেকোনো অ্যাকশন দৃশ্য ধারণ করা সম্ভব।
লেখাপড়ার পাশাপাশি অ্যাকশন দৃশ্যের ভিডিও বানিয়ে প্রশংসায় ভাসছেন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া এলাকার এই তরুণরা। মাদক থেকে দূরে থাকতে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বা গেমস খেলে সময় নষ্ট না করে ভিন্ন কিছু করার পরিকল্পনা খেকেই এমন উদ্যোগ তাদের।
তামিল সিনেমা বাহুবলি: দ্য বিগেনিং, দ্য রিটার্ন অব রেবেল, কেজিএফ, ডিজেসহ আরও বেশ কিছু সিনেমা থেকে নেওয়া তাদের তৈরি অ্যাকশন দৃশ্যের ভিডিও নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে- সামান্য একটি স্মার্টফোন দিয়েই তামিল মুভির অ্যাকশন দৃশ্য অবিকল ধারণ করছে এই ক্ষুদে নির্মাতারা। দেখে মনে হতেই পারে দৃশ্যটি তামিল কিংবা ভারতের বিপুল বাজেটের অ্যাকশন ক্লিপ। সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই ক্ষুদে তরুণদের প্রতিভা দেখে হতবাক জেলাবাসী।
নেই কোনো ক্যামেরা বা পেশাদার ক্যামেরাম্যান। নিজেদের ব্যবহৃত সাধারণ একটি স্মার্টফোন, এর সঙ্গে ব্যবহার করা হয় ধুলা ও আটা, খেলনা অস্ত্র এবং রক্তের জন্য আলতা। এসব দিয়েই তামিল সিনেমার আদলে অ্যাকশন দৃশ্য ধারণ, ভিডিও এডিটিংসহ সব কিছু মোবাইল ফোনে করা হয়।
শুটিংয়ের আকার ও প্রকারভেদে একটি ভিডিও তৈরি করতে সময় লাগে এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিন। সর্বশেষ ধারণকৃত অ্যাকশন দৃশ্যের সঙ্গে তামিল সিনেমার সাউন্ড ইফেক্ট জুড়ে দেওয়া হয়। এতে নিখুঁতভাবে ফুটে উঠে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ক্ষুদে নির্মাতাদের তৈরি অ্যাকশন দৃশ্য। আর এই শুটিংগুলো করা হয় আশপাশের এলাকায়।
হাওরপাড়ের এই অ্যাক্টরদের মনে প্রশ্ন, অন্যরা পারলে আমরা কেন পারব না? আর এ ইচ্ছা শক্তি নিয়ে আগে ফ্রিডম ফিলম সোসাইটি নামের একটি সংগঠন করা হয়। এরপর একটি ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজ খোলেন তারা। সেখানেই তাদের তৈরি অ্যাকশন ভিডিওগুলো আপলোড করা হয়। তাদের তৈরি ভিডিওগুলো দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে নেট দুনিয়ায়।
ওই ক্ষুদে নির্মাতাদের মধ্যে ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন রকি আহমেদ শুভ। আর ভিডিও এডিটর ও ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করছেন মো. জাহিদ হাসান। এ ছাড়া তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন সাজিব, জয় সরকার। তা ছাড়া অ্যাক্টর হিসেবে রয়েছেন ফারদিন, আরমান, শাহেদ, সবজল , ইমন , সাহাগির, মেহেদী , বাচ্চু , রাহুল, আকরাম। তাদের মধ্যে কেউ এসএসসি পাস করেছেন আবার কেউ নবম-দশম শ্রেণীর বা কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী।
অভিনেতা ফারদিন তালুকদার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমরা পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে এই ভিডিওগুলো করি। আমাদের ভিডিওগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে প্রকাশ করার পর খুব ভালো সাড়া পেয়েছি। তাই আমাদের এই কাজের প্রতি আগ্রহ আরও বেড়েছে।
ভিডিও এডিটর মো. জাহিদ হাসান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমরা সব কিছু মোবাইল দিয়ে করি। ভিডিও ধারণ, এডিটিংও মোবাইলে করি। এখ পর্যন্ত ল্যাপটপ বা কম্পিউটার ব্যবহার করছি না। এছাড়া আমরা সুনামগঞ্জের যে গ্রামে থাকি এটি খুবই দুর্গম এলাকা। আমরা চাইলেও ভালো একটা ভালো জায়গায় গিয়ে শুটিং করতে পারি না। তবুও আমরা আগামীতে ফিল্ম করার চেষ্টা করমু। আমাদের জন্য সবাই দোয়া করবেন।’
ডিরেক্টর রকি আহমেদ শুভ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমার অনুপ্রেরণা হচ্ছে তামিল সিনেমা, মুভিগুলো দেখে অনেক ভালো লাগত। আমার খুব মনে হতো আমরাও যদি এভাবে পারতাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি বলব আসলে বাজেট কোনও বিষয় না। যদি মনোবল আর বিশ্বাস থাকে যে এটা আমরা পারব, তাহলে অবশ্যই সম্ভব। তখন থেকে আমি তামিল মুভি দেখতাম আর অ্যাকশন দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করার চেষ্টা করতাম। আমরা খুবই চেষ্টা করি ভালো করার। আমাদের কাছে অনেক কিছুই নেই। অনেক প্রযুক্তির ব্যবহার করতে পারি না বলে কিছুটা সমস্যা হয়। তবে আমরা যদি সব ধরনের সরঞ্জাম পাই তাহলে আরও ভালো কিছু করতে পারব।’
এই তরুণ ক্ষুদে নির্মাতাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রথম অবস্থায় পরিবারের কোনো সাপোর্ট না পেলেও পরবর্তীতে তারা তাদের পরিবারকে বুঝাতে সক্ষম হন ভবিষ্যতে তারা ভালো কিছু করবেন। এখন মানুষ তাদের প্রশংসা করছে। তবে তাদের পরিবার চাইছে তারা আগে পড়াশোনা করুক, পাশাপাশি বাকি কাজ চালিয়ে যাক।
এলাকাবাসী জানায়, এমন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে তাদের সমাজের কিছু প্রতিভাবান তরুণ যে কাজটি করেছে সেটা গর্বের। তারা সামনের দিকে এগিয়ে যাক এমনটাই প্রত্যাশা তাদের।
স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী সইদুর রহমান তালুকদার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমাদের এই ভাটি অঞ্চলে অনেক গুণী শিল্পী ছিলেন। এক সময়ে যাত্রা পালা, গ্রাইম বাউল গানের আসর হইতো সবার বাড়িতে বাড়িতে। ছোট ছোট নাটক হতো, বহু অভিনেতা ছিলেন এই ভাটির শহরে। কিন্তু বর্তমানে আগের কিছুই নেই, সব হারিয়ে গেছে। এই সংস্কৃতি আবার ফিরিয়ে আনতে হলে এসব যুবকদের সহযোগিতা করতে হবে। আমার মনে হয় এই তরুণদের মাধ্যমে আমাদের ভাটি এলাকার নাম দাম সারাবাংলায় ছড়িয়ে পড়বে।
এদিকে ফাইটিং দেখে অনেকে মনে করতে পারেন এদের মাধ্যমে কিশোর গ্যাং তৈরি হতে পারে কিন্তু বাস্তবতা বলছে অন্য কথা। শিক্ষকসহ সচেতন মহল বলছেন, এটা শিল্প। এটা বিখ্যাত মরমী সাধক হাসন রাজার, বাউল আব্দুল করিমের দেশে এখানকার মানুষের সংস্কৃতির প্রেম। প্রশিক্ষণ আর প্রযুক্তির সহায়তা পেলে ভবিষ্যতে আরও ভালো কিছু করে দেখাতে পারবে তারা।
এসআইএইচ