ওসমানী মেডিকেলে জনবল সরবরাহ করছে বিতর্কিত দুই প্রতিষ্ঠান
নিয়ম লঙ্ঘন করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আউটসোর্সিং জনবল সরবরাহের জন্য দুটি প্রতিষ্ঠানকে চুড়ান্তকরণের অভিযোগ উঠেছে। প্রাপ্ত অভিযোগ অনুযায়ী, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবে দরপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানকে জনবল সরবরাহের জন্য চুড়ান্ত করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। জনবল সরবরাহে ১১টি কোম্পানি দরপত্রে অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে আল-আরাফাত সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড এবং গালফ সিকিউরিটি সার্ভিস প্রাইভেট লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকভাবে চুড়ান্ত করা হয়। তবে দরপত্রে অংশ নেওয়া অপর কোম্পানী নির্বাচিত দুটি কোম্পানীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে।
তাদের অভিযোগ, দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী কোনো কোম্পানির চেয়ারম্যান/ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নামে রাষ্ট্রবিরোধী কোনো অভিযোগ/দুদকের মামলা চলমান থাকলে তিনি দরপত্র অংশগ্রহণে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। একই সঙ্গে কল-কারখানা লাইসেন্স আপডেটের কথা উল্লেখ থাকলেও নির্বাচিত দুটি প্রতিষ্ঠানের আপডেট না থাকা স্বত্বেও তাদের অনুকূলে দরপত্র চুড়ান্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। একই সঙ্গে মেসার্স আল-আরাফাত ও গালফ সিকিউরিটি সার্ভিস প্রাইভেট লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে একাধিকবার সরেজমিনে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। পল্টন থানায় গাড়ি পোড়ানো একটি মামলায় একজন জেলও খেটেছেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে দুটি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
দরপত্রে অংশ নেওয়া ১১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধুমাত্র ‘মাছরাঙ্গা’ কোম্পানির কল-কারখানার লাইসেন্স থাকার পরও ওই প্রতিষ্ঠানকে বঞ্চিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন যমুনা স্টার সেভ গার্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাজি মোহাম্মদ সেলিম রেজার।
জানা গেছে, গত ২৫ অক্টোবর সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ও উপ-পরিচালক স্বাক্ষরিত এক স্মারক (২০২২/১৯০০ নম্বর) পত্রে নভেম্বর ২০২২ থেকে জুন ২০২৩-এই আট মাসের জন্য মেসার্স আল-আরাফাত ও গালফ সিকিউরিটি সার্ভিস প্রাইভেট লিমিটেডের নামে চুক্তি সম্পাদনের লক্ষে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে ১ কোটি ৭৪ লাখ ২০ হাজার ১৬০ টাকার বিপরীতে শতকরা ১০ টাকা হারে ১৭ লাখ ৪২ হাজার টাকা জামানত হিসেবে হাসপাতাল বরাবর ব্যাংক ড্রাফটে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশে জনবল হিসেবে ১০টি পদের বিপরীতে দুটি প্রতিষ্ঠানকে সমান সংখ্যক ২৬২টি জনবল সরবরাহের কথা উল্লেখ করা হয়।
এদিকে ওই দুইটি প্রতিষ্ঠানের নামে আদেশনামা জারির দুই দিন পর ২৭ অক্টোবর সিলেট ওসমানী হাসপাতালের পরিচালক বরাবর আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় জনবল সরবরাহে অনিয়মের অভিযোগ তোলেন দরপত্রে অংশগ্রহণ করা প্রতিষ্ঠান যমুনা স্টার সেভ গার্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাজি মোহাম্মদ সেলিম রেজা। অভিযোগ পত্রে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় জনবল সরবরাহের নিমিত্তে গত ০৪/০৭/২০২২ ইং তারিখে ওমেকহাসি/ শাখা/আউটসোর্সিং/২০২২/১২৬২/১২ নং স্মারকে আপনার দপ্তরের আহ্বানকৃত দরপত্রে আমার প্রতিষ্ঠান যমুনা স্টার সেভ গার্ড সার্ভিসেস লিঃ অংশগ্রহণ করে। উক্ত দরপত্র সিডিউলের ৫ নম্বর শর্তে উল্লেখ আছে যে দরপত্রে অংশগ্রহণকারী কোন প্রতিষ্ঠানের মালিক বা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কোন প্রকার অর্থ সংক্রান্ত মামলা, দুদকের মামলা বা কোনো প্রকার মামলা থাকলে উক্ত প্রতিষ্ঠানে অযোগ্য দর প্রস্তাবকারী হিসাবে বিবেচিত হবে।’
দরপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, জনবল নিয়োগ সংক্রান্ত এই দর প্রস্তাবটি শুধুমাত্র একটি প্যাকেজে এবং একটি লটে আহ্বান করা হয়। কিন্তু সিডিউলের শর্ত ও পিপিআর-২০০৮ লঙ্ঘন করে উল্লেখিত কাজটি ২টি প্রতিষ্ঠানকে ভাগ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়, আরাফাত সিকিউরিটি সার্ভিস ও গালফ সিকিউরিটি সার্ভিস (প্রা.) লিমিটেড নামীয় দুটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান যথাক্রমে আবু তালেব বেলায়েত ও এসবিএস খান স্বপন। তারা গাড়ি পোড়ানোসহ বেশ কিছু রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার আসামি।
তবে অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করে আরাফাত সিকিউরিটি সার্ভিস প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবু তালেব বেলায়েত বলেন, গাড়ি পোড়ানো কেন, আমার নামে বাংলাদেশের কোথাও একটি মামলারও অস্তিত্ব নেই।
কল-কারখানার লাইসেন্স আপডেট বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ এই অভিযোগটিও মিথ্যা’।
আবু তালেব বেলায়েত জানান, প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনায় সিলেটে দায়িত্ব পালন করছেন ছাত্রলীগ নেতা জাওয়াদ খান।
এদিকে এ বিষয়টি অস্বীকার করেছেন জাওয়াদ খান। তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না’। অবশ্য এ সময় তিনি জাকির নামের একজনের মোবাইল নাম্বার দিয়ে তার সঙ্গে কথা বলার জন্য অনুরোধ করেন।
এ প্রসঙ্গে গালফ সিকিউরিটি সার্ভিস (প্রা.) লিমিটেডের চেয়ারম্যান এসবিএস খান স্বপন বলেন, ‘প্রথমত আমি ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান কিংবা পরিচালক এর কোনোটিই নয়। দ্বিতীয়ত ২০১৫ সালে রাজনৈতিক কারণে আমার উপর একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিল। দীর্ঘ তদন্তক্রমে মামলাটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রমাণিত হয়েছে। এখন মামলাটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।’
স্বপন বলেন, আমি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা থাকলেও মামলা পরবর্তী দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করি। সুতরাং গালফ সিকিউরিটি সার্ভিস (প্রা.) লিমিটেডের সঙ্গে বর্তমানে জড়িত কেউই মামলার আসামি নন।
তিনি বলেন, মূলত অভিযোগকারী প্রতিষ্ঠানটি গালফ সিকিউরিটি সার্ভিস (প্রা.) লিমিটেড সম্পর্কে কোনো কিছু না জেনেই প্রতিহিংসা বশত এই মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে।
স্বপন বলেন, সিলেটে কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন ছাত্রলীগ নেতা আবদুল বাছিত রুম্মান। তবে সিলেটে কোম্পানির প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন আবদুল বাছিত রুম্মান। এর একটু পরই এসবিএস খান স্বপন মোবাইল বার্তায় সিলেটে টিপু নামের একজনের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলার অনুরোধ করেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভুঁইয়া বলেন, জনবল নিয়োগে হাসপাতালে গঠিত কমিটি সকল তথ্য যাছাই-বাছাই সাপেক্ষে চূড়ান্ত দরপত্র দাতার নামে অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করে থাকে।
তিনি বলেন, যমুনা স্টার সেভ গার্ড সার্ভিসেস শর্ত লঙ্ঘনের যে অভিযোগ তুলেছে সেটি ঠিক নয়।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভুঁইয়া বলেন, গালফ সিকিউরিটি সার্ভিস (প্রা.) লিমিটেডের চেয়ারম্যান কিংবা ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসবিএস খান স্বপন এই প্রতিষ্ঠানের কেউ নন। প্রতিষ্ঠানে যিনি চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন তাদের নামে কোথাও কোনো মামলা দায়েরের তথ্য বাছাই কমিটি খুঁজে পায়নি। একই সঙ্গে জনবল সরবরাহে চুড়ান্ত মনোনীত দুটি প্রতিষ্ঠানের সকল তথ্য আপডেট থাকায় প্রতিষ্ঠান দুটির অনুকূলে মনোনয়ন চুড়ান্ত করা হয়।
এসআইএইচ