পঞ্চগড়ে প্রাথমিকে ৮ শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন ৮ শিক্ষক
চারিদিকে শুনসান নীরবতা। নেই কোনো শিক্ষার্থীদের কলাহল। বিদ্যালয়ের ছোট্ট মাঠটিও বেশ অপরিচ্ছন্ন। শিক্ষার্থীদের পাঠদানের শব্দও আসছে না কানে। সম্প্রতি বিদ্যালয়টিতে গেলে দেখা মেলে প্রাক প্রাথমিক/চতুর্থ শ্রেণির কক্ষে তৃতীয় শ্রেণির ১ জন, চতুর্থ শ্রেণির ৩ জন এবং পঞ্চম শ্রেণির ১ জন সহ ৫ শিক্ষার্থীকে এক শ্রেণিকক্ষেই পড়াচ্ছেন মীম মোস্তারিন মুন নামে এক শিক্ষক। দ্বিতীয়/তৃতীয় শ্রেণির মেঝে পানিতে থইথই করছে। শ্রেণি কক্ষে বেঞ্চ থাকলেও নেই শিক্ষার্থী। একই অবস্থা পঞ্চম শ্রেণি কক্ষেও। বলছি, পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ঝলইশালশিরি ইউনিয়নের সুভাসুজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা।
জানা গেছে, ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হয় ২০১৩ সালে। বিদ্যালয়টিতে রয়েছে প্রায় অর্ধকোটি টাকার নান্দদিক ভবন। পাঠদানের সকল উপকরণসহ রয়েছে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। তবে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ৫ জন। এর মধ্যে মামলার কারণে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে একজন শিক্ষককে। বিদ্যালয়টিতে কাগজে কলমে শিক্ষার্থী রয়েছে ৫৪ জন। তবে উপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কখনো নেমে আসে ৫ জনেরও নিচে। শিক্ষার্থী কম হওয়ায় নাখোশ বিদ্যালয়টির ছাত্র/ছাত্রীরাও।
সুভাসুজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির মিলন ইসলাম বলেন, আমাদের ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রী আছে ৫ জন। তার মধ্যে বেশিরভাগ দিন আমি একাই ক্লাশ করি। অন্যরা বিদ্যালয়ে আসে না। ম্যাডামেরা আমাদের সবাইকে এক রুমে বসিয়ে পড়ান। তবে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক দিলেন দায়সারা জবাব। জানালেন, শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসামুখী হওয়ায় বিদ্যালয়টিতে কমেছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
সুভাসুজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বিলকিস বানু বলেন, আমাদের অনেক শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় চলে গেছে। আমরা চেষ্টা করেও তাদের বিদ্যালয়ে আনতে পারছি না। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এরইমধ্যে বিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকায় বিদ্যালয়ে পড়ার মতো শিক্ষার্থীদের জড়িপ করছি আমরা।
আরও নাজুক অবস্থা পঞ্চগড় সদর উপজেলার মাগুড়া ইউনিয়নের সরকারপাড়া এলাকার কেআরএস মাগুড়া সরকারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। ওই এলাকায় এক থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে ৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি কিন্ডার গার্টেন ও ১টি হাফেজী মাদ্রাসা থাকলেও ওই এলাকার ৬২টি পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা গ্রামে রহস্যজনকভাবে ১৫০০ বিদ্যালয় প্রকল্পের আওতায় ২০১৩ সালে স্থাপিত হয় এ বিদ্যালয়টি। ২০১৪ সালে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হয়ে পাঠদান চালু করে।
জানা গেছে, ৩০ শতক জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রয়েছে প্রায় অর্ধকোটি টাকার নান্দদিক ভবন। শেখ রাসেল কর্ণার, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার সহ পাঠদান ও শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার সকল উপকরণ রয়েছে। আর আধুনিক বেসিন সুবিধা ও পরিচ্ছন্ন ওয়াশব্লকসহ রয়েছে সব ধরণের সুযোগ সুবিধা। তবে বিদ্যালয়টিতে রয়েছেন ৩ জন শিক্ষক । প্রাক প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়টিতে মোট শিক্ষার্থী রয়েছে মাত্র ২৪ জন। তার মধ্যে উপস্থিতির সংখ্যা মাঝেমধ্যে নেমে আসে ৩ থেকে ৫ জনে।
সম্প্রতি কেআরএস মাগুড়া সরকারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেলে দেখা যায়, ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির তিনজন শিক্ষার্থী এসেছেন বিদ্যালয়ে। তবে গণমাধ্যেম কর্মীদের দেখে রুবায়েত হোসেন নামে আরো এক মাদরাসা পড়ুয়া ছাত্রকে এনে বসিয়ে দেওয়া হয় ক্লাসে। ৪ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে প্রাক প্রাথমিক/৫ম শ্রেণির কক্ষে ক্লাস শুরু করেন শিক্ষক প্রতীমা রানী। বাকী দুই শ্রেণি কক্ষের ১ম/চতুর্থ শ্রেণির কক্ষটি দখল করে নিজের ৬ মাস বয়সী সন্তানের জন্য বিছানা পেতেছেন মনিরা ফেরদৌস তানহা নামে এক শিক্ষক। বারান্দার রেলিংয়ে শুকাতে দিয়েছেন সন্তানের জামা-কাপড়। অপর ২য় ও ৩য় শ্রেণির একটি কক্ষ দখল করে রেখেছেন শিক্ষক প্রতীমা রানী। ৩ বছর বয়সী মেয়ে ও নিজের প্রয়োজনে কক্ষটি ব্যবহার করেন তিনি।
বিদ্যালয়টিতে নান্দনিক খেলার মাঠ থাকলেও বেশি শিক্ষার্থী না থাকায় ও নিয়মিত কম শিক্ষার্থী আসায় পড়াশোনায় মননিবেশ ও খেলাধুলা করতে পারছেন না বলে জানান শিক্ষার্থীরা।
কেআরএস মাগুড়া সরকারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ইয়াসমিন আক্তার খুঁশি বলেন, আমি ৫ম শ্রেণিতে একাই। তবে নিয়মিত আসি। আমাদের স্কুলে শিক্ষার্থী কম হওয়ায় স্যার ম্যাডামরা আমাদের এক রুমেই পড়ান। স্যাররা ভালোভাবে পড়ালেও আমাদের বন্ধু-বান্ধবী কম হওয়ায় স্কুলে আসতে ইচ্ছে করে না। খেলাধুলা করতে ইচ্ছে করে না।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয়দের অভিযোগ, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী আনতে ব্যর্থ হয়েছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আমিনা বেগম (৬২) নামে স্থানীয় এক বৃদ্ধা বলেন, স্কুলের স্যার ম্যাডামরা নিয়মিত আসলেও স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী অনেক কম। ছোট্ট একটা গ্রাম নিয়ে এই স্কুলটা। সবার বাচ্চা তো বড় হয়ে গেছে। এত ছোট বাচ্চা কি সবার বাড়িতে আছে। শিক্ষকরা বাইরে থেকে কোনো বাচ্চা আনতে পারছে না। এখানকার পড়াশোনার মানও তেমন ভালো না।
এ বিষয়ে কেআরএস মাগুড়া সরকারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আহসান হাবিব বলেন, আশপাশের ৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি মাদ্রাসা ও কিন্ডার গার্টেন থাকায় এখানে শিক্ষার্থী তেমন পাওয়া যায় না। এই সরকারপাড়া গ্রামটিকে ঘিরেই এই বিদ্যালয়। এখানে মাত্র ৬২টি পরিবার আছে। তার মধ্যে কিছু শিশু আবার আশপাশের বিদ্যালয়ে যায়। আসলে ক্লাশে একটা দুটো ছাত্রছাত্রী দেখলে আমাদেরই খারাপ লাগে।
কেআরএস মাগুড়া সরকারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হারুন অর রশিদ বলেন, বিদ্যালয়টি আমার বাবা খলিলুর রহমান সরকারের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। আমিই জমি দিয়েছি। আমাদের বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী আসলে খুবই কম। চারিদিকে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শুনেছি যেসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কম সেসব বিদ্যালয়ে অন্য বিদ্যালয় থেকে ছাত্র-ছাত্রী এনে সমন্বয় করা হবে। কিন্তু কই এখনো তো কোনো পদক্ষেপ দেখছি না।
তথ্যমতে, ২০২২ সালের ২৫ জুন বিদ্যালয়টি পরিদর্শনে আসেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা (পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন) এএফএম মোস্তফা জামান। সেদিন বিদ্যালয়টিতে ১১ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকলে শিক্ষক ছিলেন ৫ জন। পরে তিনি ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থীকে দেখে দেখে পড়তে বললে শিক্ষার্থীরা সাবলিল ভাবে পারেনি। এ ছাড়াও বাক্য রচনা, যুক্তবর্ণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেও তারা কোনো উত্তর দিতে পারেনি। পরে তিনি পরিদর্শন শেষে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাঁর পরিদর্শনকাল পর্যন্ত জেলা পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেননি। তবে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ওই বছরের মার্চ মাসে বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন তিনি। এ ছাড়া ওই এলাকার দেড় কিলোমিটারের মধ্যে ৪ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হওয়ায় সবগুলোকে একত্রিকরণের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেন তিনি।
সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, পঞ্চগড়ের এই দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই নয় জেলার বেশির ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। কমেছে পড়াশোনার মান। অনেক বিদ্যালয়ের ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা দেখে দেখে পড়তেও পারেন না। এ ছাড়াও জেলার অনেক বিদ্যালয়ে নান্দনিক ভবনসহ সব ধরণের সুযোগ সুবিধা ও প্রশিক্ষপ্রাপ্ত শিক্ষক থাকলেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম। শিক্ষার্থীর উপস্থিতির এমন নজির দেখে হতাশ খোদ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারাও।
এ ব্যাপারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী নেই অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থী সমন্বয় করার পরিকল্পনা রয়েছে। এরইমধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে অধিদপ্তর থেকে প্রতিনিধি দল পরিদর্শন করে গেছেন। তারা এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো নিয়মিত মনিটরিং না করা, ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের কার্যকর ভূমিকা না থাকায় এবং অন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,কিন্ডার গার্টেন ও করোনাকালে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী চলে যাওয়ায় এমন নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
এসআইএইচ