ডাক্তার না হয়েও করছেন রোগীর সিজার
নীলফামারীর ডিমলায় নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও সিজার করে যাচ্ছেন কথিত চিকিৎসক রঞ্জিত দেবনাথ। নিজে কখনও ডাক্তারি পড়েননি বা চিকিৎসা সম্পর্কিত কোনো কোর্সও করেননি। এমনকি মাধ্যমিক পাশও করেননি। অথচ একের পর এক সিজার করে চলেছেন জেলার ডোমার-ডিমলাসহ বিভিন্ন উপজেলার বিভিন্ন ক্লিনিকে। এ জন্য রোগীরা তাকে চিনে রনজিৎ ডাক্তার হিসেবে।
গোপনে সংবাদ পেয়ে শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) রাতে ডিমলা উপজেলার মেডিনোভা ক্লিনিকে ওটি রুমে গিয়ে দেখা যায়, রন্ঞ্জিত ও ওই ক্লিনিকের আবাসিক মেডিকেল অফিসার পরিচয়দানকারী জাহাঙ্গীর আলম মিলে একজন রোগীর সিজার করছেন। সেখানে কোনো অজ্ঞান করার ডাক্তার ও নার্স নেই।
রোগীর অভিভাবক জানান, ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ যে ডাক্তারের কথা বলে রোগী ভর্তি করিয়েছেন। এখন শুনছি অন্য ডাক্তার সিজার করেছে। এটা এক ধরনের প্রতারণা।
এ বিষয়টি ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বেলায়েত হোসেনকে জানালে তিনি ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। এর আগে সোমবার (১৬ জানুয়ারি) ওই ক্লিনিকে অভিযান চালিয়ে ক্লিনিকটি সিলগালা করে দেওয়া হয় বলে জানান ইউএনও।
এ প্রসঙ্গে মেডিনোভা ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হর্ষবর্ধন জানান, রন্ঞ্জিত তার প্রতিষ্ঠানে সার্জনের সহকারী হিসেবে অপারেশনে অংশ নেন । তবে রন্জিতের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান তিনি।
তাহলে রোগীর সার্জারি করল কে এমন প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, রন্ঞ্জিত উপজেলার বিভিন্ন ক্লিনিকে নিয়মিত কাজ করেন। তাই আমরাও কাজ করাই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার জলঢাকা উপজেলার খেরকাটি গ্রামের বাসিন্দা রন্ঞ্জিত। খেরকাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি। তারপর অফিস সহায়ক ও ওটি বয় হিসেবে ডোমারের ফ্রেন্ডস ক্লিনিকে কাজ করেন কয়েক বছর। বর্তমানে ডোমারের সেভেন স্টারসহ বেশ কয়েকটি ক্লিনিকে মালিকানা রয়েছে তার।
ডোমার ফ্রেন্ডস ক্লিনিকের ব্যবস্থাপক কমল দেবনাথ বলেন, রঞ্জিত আমাদের ক্লিনিকে প্রথমে অফিস সহায়ক হিসেবে কয়েক বছর কাজ করেছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে বাদ দেওয়া হয়।
জেলার বেশ কয়েকটি ক্লিনিকের পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, বিভিন্ন ক্লিনিকে কখনও সার্জারি ডাক্তার, কখনও সহকারী সার্জন পরিচয়ে কাজ করছেন রন্ঞ্জিত। শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পাশ হলেও নিজেকে ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দেন। রোগীদের ব্যবস্থাপত্রও লিখে দেন। তার অপচিকিৎসার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন একাধিক রোগী। তার মধ্যে অন্যতম জলঢাকা উপজেলার ধর্মপাল ইউপির সবুজপাড়া গ্রামের রবিউল ইসলামের স্ত্রী মেঘলা বেগম (২০)। এ ঘটনায় রবিউল ইসলাম ভুয়া সার্জারি ডাক্তার রন্ঞ্জিতকে আসামি করে ডোমার থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি বর্তমানে নীলফামারী আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
ডোমারের এক ডাক্তার জানান,স্থানীয় নিহার রঞ্জনের ছত্রছায়ায় তিনি বিভিন্ন ক্লিনিকে তার সঙ্গে সিজারের কাজ করে থাকেন। ডোমারের প্রায় প্রতিটি ক্লিনিকে তিনি সিজার করে থাকেন।
জামিরবাড়ী এলাকার সুরেশ বলেন, তার ভাতিজীর বউকে সিজারের জন্য সেভেন ষ্টার ক্লিনিকে নিয়ে গেলে বলা হয় ডাঃ আইনুলের দ্বারা সিজার করা হবে। কিছুক্ষণ পর দেখি রঞ্জিতকে দিয়ে সিজার করাচ্ছে। কারণ জানতে চাইলে তারা বলেন আইনুল ডাক্তার আসতে পারবে না তাই আমরা করাচ্ছি। দুই দিন পর দেখি সেলাইয়ের জায়গা দিয়ে রস পরছে। রসের কথাটা রঞ্জিতকে বলার পরেই তিনি রেগে উঠেন।
এসব বিষয়ে রঞ্জিত বলেন, ওটিবয় হিসেবে ডাক্তারদের সঙ্গে কাজ করতে করতে সার্জারি করা শিখেছি। কোনো ডাক্তার বা ক্লিনিক ডাকলে সহকারী হিসেবে কাজ করে দেই। আমার কোনো ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা নেই।
এদিকে ওটি ইনচার্জ ও ওটি এসিস্ট্যান্টের নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ডোমার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক (গাইনি বিষয়ে অবিজ্ঞ) ডা. আইনুল হক জানান, একজন ওটি ইনচার্জকে কমপক্ষে ডিপ্লোমা নার্স হতে হবে এবং ওটিতে সার্জনের ফার্স্ট এসিস্ট্যান্ট হতে হলে অবশ্যই তাকে একজন ডাক্তার হতে হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রাশেদুজ্জামান জানান, কোনো প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির অপকর্মের অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে মেডিনোভা ক্লিনিকটি সিলগালা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ভুয়া ডাক্তারের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। ভবিষ্যতে কর্তৃপক্ষের নজরদারি বৃদ্ধি করা হবে বলে জানান তিনি।
এ ঘটনায় কথিত চিকিৎসক রঞ্জিতের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তিনি আরও জানান, ডাক্তার পরিচয় দেওয়া রঞ্জিত অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই গাড়ি-বাড়ী করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন।
এসআইএইচ