চালক না থাকায় ২ বছর ধরে তালাবদ্ধ অ্যাম্বুলেন্স, ভোগান্তি
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও চালক না থাকায় ২ বছর ৪ দিন ধরে অ্যাম্বুলেন্স সেবা পাচ্ছেন না ফুলবাড়ীবাসী। অ্যাম্বুলেন্স সেবার পাশাপাশি পর্যাপ্ত ডাক্তার না থাকায় চিকিৎসাসেবা থেকেও বঞ্চিত তারা। এ ছাড়া পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে আল্ট্রাসনোগ্রাম, এক্স-রেসহ ইসিজি সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। ফলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে রোগীসহ তাদের স্বজনদের।
এসব ভোগান্তি সহ্য করেই রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বাধ্য হয়ে বেশি টাকায় মাইক্রোবাস-প্রাইভেট কারসহ বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে কুড়িগ্রাম অথবা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতালে ছুটছেন স্বজনরা। টানা ২ বছর ৪ দিন অতিবাহিত হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অ্যাম্বুলেন্স সেবা দিতে না পাড়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন উপজেলার হাজারো মানুষ। তবে এসব দেখার যেন কেউ নেই।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের ১৩ জানুয়ারি তৎকালীন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সামছুন্নাহারসহ অপর একজন ডাক্তারের সরকারি কোয়ার্টারে চুরির ঘটনা ঘটে। কোয়ার্টারের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে চুরির সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে ৪ জনকে আটক করে পুলিশ। নির্দেশদাতা হিসেবে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সচালক একাব্বর আলীকেও (৪৭) আটক করা হয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে চুরির মামলা দিয়ে কুড়িগ্রাম কারাগারে পাঠায় পুলিশ। আর নির্দেশদাতা হিসেবে অ্যাম্বুলেন্সচালক একাব্বর আলীকে ১৩ জানুয়ারি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেই থেকে গ্যারেজে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে অ্যাম্বুলেন্সটি। এভাবে অযত্নে অ্যাম্বুলেন্সটি পড়ে থাকায় এর বিভিন্ন সমস্যার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। গত বছরের ১১ এপ্রিল অ্যাম্বুলেন্সচালক একাব্বর আলী কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে আসলেও বরখাস্ত থাকা অবস্থায় ওই চালক দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স চালানোর নিয়ম নেই বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতাল সূত্রে আরও জানা যায়, ইসিজি, এক্স-রে মেশিনের টেকনিশিয়ান না থাকায় দীর্ঘদিন এ সেবা থেকে বঞ্চিত রোগীরা। আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনটিও দীর্ঘদিন পড়ে থাকতে থাকতে নষ্ট হয়ে যায়। হেলথ সহকারীর ২৫ পদ থাকলেও বর্তমানে এ পদে আছেন ১৫ জন। অন্যদিকে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটিতে চিকিৎসকের পদ ২১ জন। কিন্তু সেখান আছেন কেবল ৮ জন। এই ৮ চিকিৎসক দিয়ে কচ্ছপ গতিতে চলছে চিকিৎসাসেবা।
এদিকে টানা ১ মাস ধরে ঘনকুয়াশা ও কনকনে ঠান্ডাসহ মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বিরাজ করায় শিশু ও প্রবীণরা শীতজনিত রোগে ভুগছেন। ফলে হাসপাতালে শিশু রোগীর সংখ্যা বাড়লেও শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় অভিভাবকরা পড়েছেন বিপাকে। ফলে তাদেরকে তীব্র শীত উপেক্ষা করে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও রংপুরে গিয়ে শিশুসহ শীতজনিত রোগীদের চিকিৎসা করাতে হচ্ছে।
ভাঙ্গামোড় ইউনিয়নের বোয়াইলভীর এলাকার মানিক চন্দ্র রায় বলেন, দুই-তিনদিন আগে আমার স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ হলে আমি ফুলবাড়ী হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সচালক একাব্বর আলীকে ফোন দেই। তিনি জানান, আপাতত সরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালানো নিষেধ। আমার কাছে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স আছে। পরে মানিক চন্দ্র বাধ্য হয়ে আড়াই হাজার টাকা ভাড়ায় রোগীকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
শুধু মানিক নয়, এই দুই বছরে তার মতো শতশত রোগীর স্বজনরা তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বেশি টাকায় বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স ও মাইক্রোবাস ভাড়া করে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও রংপুর মেডিকেলে নিয়ে যান। তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সচালক দিয়ে ফুলবাড়ী মানুষের অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।
ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়নের চন্দ্রখানা এলাকার বাসিন্দা মানিক সদ্দার ও এমদাদুল হক মিলন জানান, দুই বছর অতিক্রম করলেও অ্যাম্বুলেন্সের চালক না থাকায় উপজেলার শতশত রোগীসহ স্বজনরা চরম বিপাকে পড়েছেন। বিত্তশালীরা বাধ্য হয়ে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সসহ মাইক্রোবাস ভাড়া করেই অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসার জন্য রংপুরে নিতে পারলেও মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষজন পড়েছেন বিপাকে।
তারা আরও জানান, অ্যাম্বুলেন্সের চালকসহ হাসপাতালটিতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় চরম সংকটেও পড়েছে রোগীসহ স্বজনরা। তারা জরুরি ভিত্তিতে অ্যাম্বুলেন্সের চালক ও একজন শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ হাসপাতালটিতে সব সমস্যার সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।
বরখাস্তকৃত অ্যাম্বুলেন্সচালক একাব্বর আলী বলেন, ২০২১ সালের ১৩ জানুয়ারি তৎকালীন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সামছুন্নাহার আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে চুরির নির্দেশদাতা হিসেবে মামলা দেয়। মামলা হওয়ায় ওই বছরের ১৩ জানুয়ারি আমাকে সাময়িক বরখাস্ত করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এদিকে টানা দুই বছর ৪ দিন থেকে বেতন কমে যাওয়ায় পরিবার নিয়ে অতি কষ্টে জীবনযাপন করছি।
তিনি আরও বলেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্তের পর আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠান। তাই আমি আদালতের কাছে মামলা নিষ্পত্তির জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুমন কান্তী সাহা বলেন, অ্যাম্বুলেন্সচালক একাব্বর জামিনে মুক্ত হলেও আদেশ তুলে না নেওয়া পর্যন্ত ওই চালক দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স চালানোর নিয়ম নেই। তাই গত ২ বছর ৪ দিন থেকে অ্যাম্বুলেন্সটি তালাবদ্ধ অবস্থায় গ্যারেজে পড়ে আছে। ইতোমধ্যে অ্যাম্বুলেন্সচালক, একজন শিশু বিশেষজ্ঞসহ চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে স্থানীয় প্রশাসন, সংসদ সদস্যসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করি খুব দ্রুত সময়ে সব সমস্যার সমাধান হবে।
এ প্রসঙ্গে জেলা সিভিল সার্জন ডা. মনজুর এ মোর্শেদ বলেন, যেহেতু চালকের নামে মামলা আছে এবং তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে তাই তাকে দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স চালানোর কোনো নিয়ম নেই। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় মামলা নিষ্পত্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এসজি