শান্তিরক্ষা মিশনে বিস্ফোরণ
‘মিশন শেষ, কিছুদিন পরেই দেশে আসিম’
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার লতিফর রহমানের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম। মধ্য আফ্রিকায় শান্তিরক্ষা মিশনে গিয়ে বোমা বিস্ফোরণ মারা গেছেন তিনি। ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে নির্বাক হয়ে পড়েছেন মা গুলেনাহার বেগম। শয্যাশায়ী মা গুলেনাহার বলেন, ‘কয়েকদিন আগে অনলাইনে ব্যাটার (ছেলের) সাথে কথা হইল, কইল মা-মুই ভালো আছো (আছি)। মিশন শেষ হয়ছে। কিছুদিন পর দেশে আসিম (আসব)। তোমরা ভালো থাকো।’
এসব কথা বলতে বলতে ভাষা হারিয়ে ফেলা মা আবারও বললেন, ‘ছেলেটাক ক্যানে মরি গেইল, আল্লাহ মোকে আগোত (আগে) নিয়া গেইলে তো হইল হয়। মুই ছেলেটাক দেখির (দেখতে) চাও (চাই)।’
ছেলেকে হারিয়ে মুখ থেকে বের হচ্ছে না বাবা লতিফর রহমানের। এ নিয়ে বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। থামানো যাচ্ছে না তার স্ত্রী শিমু আকতারের কান্না।
বুধবার জাহাঙ্গীর আলমের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সরেজমিনে এমন চিত্র দেখা গেছে। এ সময় আরও দেখা যায়, জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর সংবাদ জানার পর থেকেই তার পরিবারকে সমবেদনা জানাতে তাদের বাড়িতে ভিড় করছেন স্থানীয় মানুষরা। বুধবার সকালে সমবেদনা জানাতে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন ও ডিমলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) লাইছুর রহমানও।
বাবা লতিফর রহমান বলেন, ‘আমার বাবাটা দুর্ঘটনাত মারা গেছে শুনছি। মোর ছাওয়াটাক (ছেলেটার) মুই দেখির চাও। কদদিন মোর ব্যাটাটা আসিবে। তাড়াতাড়ি যেন নিয়া আইসে বাবাক (বাবাকে)। সরকারের কাছে আবেদন, সোনামুখটার তাড়িতাড়ি যেন দেখির ব্যবস্থা করি দেয়।’
জানা গেছে, বাবা-মায়ের পাঁচ সন্তানের মধ্যে জাহাঙ্গীর আলম চতুর্থ। সবার বড় আবুজার রহমান। তিনিও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য। দিনাজপুরের খোলাহাটি সেনানিবাসে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। প্রথমে দুর্ঘটনার খবরটি সেনাবাহিনী থেকে তাকেই জানানো হয়। ছুটি দেওয়া হয় বাড়িতে ফেরার জন্য।
আবুজার রহমান বলেন, ‘জাহাঙ্গীর আলম পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে চতুর্থ সে। বাকি দুই ভাই প্রাইভেট জব করলেও আমরা দুজন সরকারি চাকরিতে। একেবারে ছোট বাদশা মিয়া রংপুরে পড়ছে পলিটেকনিকে।’
তিনি আরও বলেন, জাহাঙ্গীরকে হারানোর যে দুঃখ বেদনা কীভাবে সইব আমরা। একজন চলে যাওয়া মানে বিরাট ক্ষতি হওয়া। সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি দেখভাল করছেন মরদেহ দেশে আনার ব্যাপারে।’
চার বছর আগে জলঢাকা উপজেলার মীরগঞ্জ ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের সিরাজুল ইসলামের মেয়ে শিমু আকতারের সঙ্গে বিয়ে হয় জাহাঙ্গীর আলমের। মৃত্যুর বিষয়টি জানার পর থেকে কোনোভাবে থামানো যাচ্ছে না তাঁর কান্না।
কান্নাজড়িত অবস্থায় শিমু জানান, পরশু ভিডিও কলে কথা হয় ওর সঙ্গে। জানালো ভালো আছি। কোনো সমস্যা নেই। মিশন তো শেষের পথে। কিছুদিন পরই আসছি। ভালো থাকো।
শিমু বলেন, ‘দ্রুত আমার স্বামীর মৃতদেহ যেন দেশে আনা হয়। সরকার এবং সেনাবাহিনী প্রধানের কাছে আমার এই আবেদন।’
প্রতিবেশী শামসুল হক বলেন, ‘সভ্য, সহজ, সরল প্রকৃতির মানুষ ছিল জাহাঙ্গীর। ভালো খেলোয়াড়ও ছিল। তার মতো ছেলে এই এলাকায় নেই। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুক।’
এ ব্যাপারে ইউএনও বেলায়েত হোসেন জানান, ঘটনাটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। দেশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন জাহাঙ্গীর। নিহত হওয়ার ঘটনায় শোক ও শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।
মরদেহ দেশে আনার বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএনও বলেন, ‘দাপ্তরিকভাবে এখনও আমার কাছে কোনো তথ্য আসেনি। তারপরও বিষয়টি খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে।’
আইএসপিআর সূত্রে জানা গেছে, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনার সময় তিন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত হন। এর মধ্যে নীলফামারীর জাহাঙ্গীর আলমও রয়েছেন। গত ৩ অক্টোবর সোমবার রাত ৮টা ৩৫মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ৪ অক্টোবর দুপুর ১টা ৩৫মিনিট) শান্তিরক্ষীদের একটি গাড়ি ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বিষ্ফোরণে বিষ্ফোরিত হয়।
এসআইএইচ