পীরগঞ্জের সেই জেলে পল্লীতে নেই আতঙ্ক
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের জেলেপাড়া বড়করিমপুর গ্রামে মানুষের আতঙ্ক নেই ফিরেছে কর্মঞ্চাল্য সম্প্রীতির বন্ধন। মুক্ত ডানা মেলে পাখিরা দল বেঁধে ছুটছে এ গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। বাংলার ঋতুর খেলায় মাজে মধ্যেই মেঘাছন্ন আকাশে সাদা-কালো মেঘের খেলা। এই মেঘের আড়াল থেকে লুকোচুরি করছে সূর্য্য মামা। সূর্যের কিরনএসে পড়ছে রঙিন টিনের ছাউনি দেওয়া পাকা ঘর গুলোতে। যেন এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। এ দৃশ্যের দেখা মিলেছে পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের জেলেপাড়া বড়করিমপুর গ্রামে। রংপুর জেলা জুড়ে এটি জেলেদের পল্লী হিসেবে পূর্ব পরিচিত।
উল্লেখ্য, গত ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননার একটি পোস্ট দেওয়ার অভিযোগ তুলে রাতের অন্ধকারে ওই গ্রামের হিন্দু জেলেদের বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাট করে গ্রামটি জ্বালিয়ে দিয়েছিল উত্তেজিত জনতা। গভীর রাতে উত্তেজিত জনতার হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যান জেলেরা। আগুনে পুড়ে যায় ধান-চাল জাল কাপড়-চোপড় গরু রিকশা-ভ্যান বসতবাড়ি সহ সাজানো সংসারের সবকিছু। এঘটনায় নিঃস্ব হয়ে পড়েন জেলেরা। এ নিয়ে পীরগঞ্জ থানায় পৃথক চারটি মামলা দায়ের করে পুলিশ।
গ্রেপ্তার করা হয় চিহ্নিত আসামিদের। সরকারী আর্থিক সহযোগীতা পাওয়ায় ক্রমান্বয়ে জেলেরা আতঙ্ক কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে থাকেন। পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের জেলেপাড়া বড়করিমপুর গ্রামে ঘটনার ১০ মাস পর গিয়ে দেখা যায়, মানুষের আতঙ্ক নেই ফিরেছে কর্মঞ্চাল্য সেখানে রীতিমতো চলছে আনন্দ ও সম্প্রীতির বন্ধন। ঘরবাড়ি পুড়ে যাওয়ার নেই কোনো চিহ্ন। যে যাঁর মতো গ্রামে-মাঠে কাজ করছেন। বসে গল্প করছেন। জেলেরা অনেকে মাছ ধরে বাড়িতে ফিরছেন। চকচক করছে গ্রামের রঙিন টিনের ছাউনি দেওয়া পাকা বসত বাড়ি।
জেলে পল্লীর পাশের বটেরহাট থেকে শুরু করে বিভিন্ন দোকানে ও গ্রামের ভেতরে সম্প্রীতির বন্ধন। হিন্দু-মুসলমান একই সঙ্গে বসে চা পান করছেন আড্ডা দিচ্ছেন হাট বাজারও করছেন। রামনাথপুর ইউনিয়নের জেলেপাড়া বড়করিমপুর গ্রামের ননী গোপাল (৬০) নতুন বসতঘরের বারান্দায় শুয়ে ছিলেন। কেমন আছেন, জানতে চাইলে বলেন, ভগবানের আশীর্বাদে এখন খুব ভালো আছি। দালানের নয়া ঘর পাছি, অনুদান পাছি। অ্যালা হিন্দু-মুসলমান সবায় একসঙ্গে খাওচি-দাওচি-ঘোরোচি কোনো সমস্যা নাই।
জেলেপাড়া বড়করিমপুর গ্রামের ননী গোপাল (৬০), সুমতি রানী (৪৫), দেবেন্দ্রনাথ সহ আরো অনেকেই বলেন এমন অনেক কথা। পীরগঞ্জের জেলেপাড়া বড়করিমপুর গ্রামের ননী গোপাল (৬০) মাঝিপাড়া গ্রামের পাশে বটেরহাট বাজারে মুদিখানা ও চায়ের দোকানগুলোতে দেখা গেল মানুষের আড্ডা। বাজারের রাসেল মিয়ার চায়ের দোকানে মজনু মিয়া, রিপন ইসলাম ও আবদুল কাইয়ুমের সঙ্গে বসে চা পান সহ খোশগল্পে মেতেছিলেন মাঝিপাড়া বড়করিমপুর গ্রামের নির্যাতিত জেলে ক্ষুধা রাম, দেবদাস, প্রভাত দাস ও সাগর রায়। সেদিনের ঘটেযাওয়া কথা তুলতেই প্রভাত দাস বলেন, অ্যালা সউগ আগের মতোন হয়া গেইছে।
পীরগঞ্জের বটের হাটবাজারের জামে মসজিদের সামনে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পে বসে ছিলেন জেলেপাড়া গ্রামের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মামুনুর রশিদ।তিনি বলেন,গ্রামে হামলার ঘটনার পর থেকে এখানে পুলিশি পাহারা চলছে। আমি দুই মাস থেকে এখানে পাহারার দায়িত্বে আছি। হিন্দু-মুসলমানরা এখন কাঁধে কাঁধ রেখে আগের মত সামাজিক ভাবে চলাচল করছেন।
পীরগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহাবুবুর রহমান বলেন, ওই দিন রাতের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে পীরগঞ্জ থানায় পৃথক চারটি মামলা দায়ের করে। এর মধ্যে তিনটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। চার মামলায় মোট ১৫০ জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। দায়ের করা চার মামলার একটিতে চার্জসিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে। বাকী ৩টি মামলা পুলিশ তদন্ত করছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ আসিফ আহসান বলেন, ক্ষতি গ্রস্থদের টিনের ছাউনি সহ ৪৪টি পাকা ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলেরা সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে আর্থিক সহ সকল প্রকারের সহযোগিতা পেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এখন এলাকায় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতির বইছে সম্প্রীতির বন্ধন।
এএজেড