পঞ্চগড়ে নৌকাডুবি
মায়ের অপেক্ষায় শিশু অরণ্য

তিন বছরের ফুটফুটে শিশু অরণ্য। নির্বাক তবে দৃষ্টিতে খানিকটা বিস্ময়, খানিকটা বিষণ্নতা। ছয় দিন ধরে মা তার কাছে আসছে না, তাকে কোলে নিচ্ছে না, আদর করছে না। খুঁজেও পাচ্ছে না। দাদি ফুলতে রানীর কোলে চড়ে এদিক ওদিকে তাকিয়ে খুঁজছে মাকে। অরণ্য জানে না, মা আর কোনো দিন আসবে না তার কাছে। চলে গেছে অনেক দূরে; যেখান থেকে আর ফেরা যায় না।
অরণ্যের মা রূপালী রানী (৩০) মহালয়া ধর্মসভায় যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে মারা যান। এর একদিন পর করতোয়া নদী থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। একই ঘটনায় অরণ্যের আরও চার ঘনিষ্ঠজন মারা যান। এখনো একজন নিখোঁজ রয়েছে। অরণ্যদের বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আরাজি শিকারপুর এলাকায়। তার বাবার নাম বাসুদেব চন্দ্র রায়।
অরণ্যদের বাড়ির কাছাকাছি যেতেই কোনে পৌঁছে স্বজনহারাদের কান্নার রোল। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে কান্নাকাটি করছে। কে কাকে শান্ত্বনা দেবে? তবে নির্বাক অরণ্য। বাবা বাসুদেব ও বোন নন্দিনী কেঁদেই চলেছেন। তাদের সমবেদনা জানাতে এসে ভারাক্রান্ত প্রতিবেশীরাও। আহাজারি আর দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠেছে এলাকার পরিবেশ। বাড়িতে বাড়িতে শোকের মাতম।
গত রবিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) বড়শশী ইউনিয়নের বোদেশ্বরী মন্দিরে ধর্মসভায় যোগ দিতে মাড়েয়া আউলিয়া ঘাট হয়ে করতোয়া নদী পারাপারের সময় নৌকাডুবির শিকার হন অরণ্যর মা রূপালী রানীসহ তার আরও ৭ স্বজন। এঘটনায় অরণ্যর বড় বোন নন্দিনীসহ তিনজন বেঁচে ফিরলেও মা রূপালীসহ চারজন ফেরেন লাশ হয়ে। আরেকজন নিখোঁজ রয়েছে এখনো। নানার বাড়িতে থাকায় সেদিন মায়ের সঙ্গী হতে পারেনি অরণ্য।
বাসুদেব চন্দ্র জানান, খুব আনন্দ উদ্দীপনা নিয়েই তার স্ত্রী রুপালি রানী, মেয়ে নন্দিনী, বৌদি কবিতা রানী, ভাতিজি আলো রানী, অর্পিতা রানী, শ্যামলী রানী এবং আলোর মেয়ে জয়া রানী ও জ্যোতি রানী বোদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া ধর্মসভার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন। কিন্তু নদী পার হতে গিয়ে ম্লান হয়ে যায় সব আনন্দ। নৌকাডুবির ঘটনায় তার মেয়ে এবং দুই ভাতিজি বেঁচে ফিরলেও লাশ হয়ে ফিরেছে চারজন। এখনো নিখোঁজ রয়েছে নাতনি জয়া রানী।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। আর মহালয়া দিয়ে এই উৎসবের শুরু। কিন্তু উৎসবের প্রথম দিনেই হারিয়ে ফেললাম সারাজীবনের সব আনন্দ।
এর আগে, গত রবিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) শারদীয় দুর্গোৎসবের মহালয়া উপলক্ষে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া আউলিয়া ঘাট থেকে শতাধিক মানুষ শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকায় করে বড়শশী ইউনিয়নের বোদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিলেন। ঘাট থেকে নৌকাটি কিছু দূর যাওয়ার পর দুলতে শুরু করে। এক পর্যায়ে নৌকাটি ডুবে যায়। পরে উদ্ধার অভিযান শুরু করে প্রশাসন। এঘটনায় মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত ৬৯ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছে তিনজন।
স্থানীয়রা জানান, বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের করতোয়া নদীর অপরপাড়ে বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া পূজা উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারও ধর্মসভার আয়োজন করা হয়। রবিবার দুপুরের দিকে মূলত ওই ধর্মসভায় যোগ দিতে সনাতন ধর্মালম্বীরা নৌকা যোগে নদী পার হচ্ছিলেন। তবে ৫০ থেকে ৬০ জনের ধারণ ক্ষমতার নৌকাটিতে দেড় শতাধিক যাত্রী ছিল।
এদিকে, ঘটনার পরপরই অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর রায়কে প্রধান করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর রায় বলেন, তদন্ত কমিটির সদস্যরা নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান, মরদেহ উদ্ধার ও পরিবারগুলোকে বিভিন্ন সহায়তা প্রদানে সক্রিয় থাকায় তদন্ত প্রতিবেদনের সময় তিন দিন বাড়ানো হয়েছে।
এসএন
