কুড়িগ্রামে ইউএনওর অবহেলায় প্রশ্নপত্র ফাঁস!
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মার গাফলতির কারণে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধিনে ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় চলতি এসএসসি, দাখিল, এসএসসি (ভোকেশনাল) এবং দাখিল (ভোকেশনাল) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আর এসব বিভাগের শত-শত শিক্ষার্থীর জন্য বোর্ড কর্তৃক পরীক্ষার জন্য প্রদত্ত কয়েক হাজার প্রশ্নপত্র সেটের প্যাকেট পাঠিয়ে দেয়। এসব প্যাকেট থেকে প্রশ্ন সটিং এবং যাচাই-বাছাই করার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একজন প্রতিবেদন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মা গত ১১ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত ০৫.৪৭.৪৯০৬.০০০.১৩.০২৩.২২.৮৫৯ নং স্বারকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও অন্যান্য গোপনীয় কাগজ পত্রাদি যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন জমা দেবার জন্য উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুর রহমানকে দায়িত্ব দেন। পত্রে বলা হয় ভূরুঙ্গামারী থানায় প্রশ্ন পত্র ও অন্যান্য গোপনীয় কাগজপত্রাদি সংরক্ষিত রয়েছে।
উক্ত সিলগালাকৃত পরীক্ষার প্রশ্ন পত্র ও অন্যান্য গোপনীয় কাগজপত্রাদি বিবরণী মোতাবেক সঠিক আছে কিনা তা যাচাই-বাছাই করে ১৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের করার জন্য অনুরোধ করেন। এই পত্রের অনুলিপি দেয়া হয় ভূরুঙ্গামারী থানার অফিসার ইনচার্জসহ উপজেলার ৬টি পরীক্ষা কেন্দ্রের সকল সচিবগণকে। পত্রে আরও উল্লেখ্য করা হয়, পরীক্ষার সময়সূচি অবশ্যই খামের উপরে লিখতে হবে।
এছাড়াও একই তারিখে ইউএনওর স্বাক্ষরিত ০৫.৪৭. ৪৯০৬. ০০০.১৩.০২৩.২২নং স্বারকে এক অফিস আদেশে ভূরুঙ্গামারী পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় পরীক্ষা কেন্দ্রে কৃষি কর্মকর্তা আপেল মাহমুদ, সমবায় অফিসার নুর কুতুবুল আলম। নেহাল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে মৎস্য কর্মকর্তা আদম মালিক চৌধুরী, পল্লী উন্নয়ন অফিসার রায়হান হক। সোনাহাট দ্বি-মুখি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে সহকারি শিক্ষা অফিসার আবুল কালাম আজাদ, প্রতিবন্ধি বিষয়ক কর্মকর্তা আব্দুল আহাদ।
সোনাহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের ইনস্ট্রাক্টর আতিকুর রহমান, সহকারি পল্লী উন্নয়ন অফিসার রেজাউল করিম। ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা কেন্দ্রে সহকারি শিক্ষা জাকির হোসেন, জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপ-সহকারি প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম। দিয়াডাঙ্গা আইডিয়াল টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রে সহকারি প্রোগ্রামার রুবেল সরকার এবং দারিদ্র বিমোচন কর্মকর্তা মুখলেছুর রহমানকে ট্যাগ অফিসার বা দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন। তারা পরীক্ষার দিন গুলোতে থানা হতে নির্ধারিত প্রশ্নপত্র উত্তোলন নিশ্চিত এবং পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে সার্বক্ষনিক কেন্দ্রে উপস্থিত থেকে পরীক্ষা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা হয় পত্রে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ভূরুঙ্গামারী থানায় প্রশ্ন বাছাইয়ের সর্টিং করার সময় নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপজেলা মাধ্যমিক অফিসার আব্দুর রহমানের যোগসাজসে বাংলা ১ম পত্রের প্রশ্নপত্রের প্যাকেটের ভিতর বাংলা-২য় পত্র,ইংরেজি ১ম ও ২য় পত্রের প্রশ্ন পত্রের একটি করে খাম ঢুকিয়ে নেন এবং প্যাকেট সীলগালা করেন। তার ওপর স্বাক্ষর করেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান।
বাংলা ১ম পত্রের পরীক্ষার দিন যথা নিয়মে থানা থেকে বাংলা ১ম পত্রের প্যাকেট এনে তা খুলে বাংলা ২য় পত্র, ইংরেজি ১ম ও ২য় পত্রের খামটি কৌশলে সরিয়ে ফেলেন কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমানসহ তার সহযোগিরা। এ সময় কেন্দ্রে দায়িত্বরত ট্যাগ অফিসার বোর্ডের দেয়া তালিকা অনুযায়ী পাঠানো প্রশ্নে পত্রের খাম গণনা করার নিয়ম থাকলেও তারা দায়িত্ব অবহেলা করে তা করেনি।
পরে প্রধান শিক্ষক কয়েকজন শিক্ষকের সহায়তায় ফাঁস করা প্রশ্নপত্রের হাতে লেখা উত্তর পত্র তৈরী করে ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা মূল্যে বিক্রি করেন। পরীক্ষার আগের রাতে ফাঁস হওয়া উত্তর পত্রের সাথে পরের দিন পরীক্ষার প্রদত্ব প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া যায়। আর এসব উত্তর পত্র অনেকেই মোবাইলের মাধ্যমে উত্তরপত্র গোপনে ২শ থেকে ৫শ টাকা বিক্রি করেন অন্যান্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নিকট।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক উপজেলার একাধিক কর্মকর্তারা জানান, বোর্ডের নিয়মানুযায়ী পরীক্ষা শুরুর ৫/৭ দিন আগে কেন্দ্র সচিব বা তার প্রতিনিধি এবং ট্যাগ অফিসারের মাধ্যমে ট্রাংকে রক্ষিত প্রশ্নপত্রের প্যাকেটের সাথে 'প্রশ্নপত্রের চাহিদা' সঠিক ভাবে যাচাইয়ের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। কোন গড়মিল থাকলে সাথে সাথে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে লিখিতভাবে জানাতে হবে। কিন্তু ইউএনও সেই কাজ না করে এক/দুই দিনের মধ্যে একজন কর্মকর্তাকে দিয়ে প্রশ্নপত্র সটিং করে প্রতিবেদন দেবার নির্দেশ দেন।
একজন কর্মকর্তার পক্ষে হাজার, হাজার প্রশ্নপত্র এক/ দুই দিনের মধ্যে যাচাই-বাছাই, কাগজে স্বাক্ষর করা এবং নজরদারী-হিসাব করে প্রতিবেদন দেয়া প্রায় অসম্ভব। আর এই সুযোগে অসাধু কিছু শিক্ষক প্রশ্ন পত্র কৌশলে বের করেছেন। ইউএনও যদি শুরুতেই তার দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করতো তাহলে প্রশ্ন ফাঁসের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি ঘটার সম্ভাবনা ছিল না। এতে করে এসএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষাকে গুরুত্ব না দেয়ায় প্রশ্ন ফাঁসের দায় থেকে ইউএনও এড়াতে পারেন না।
ভূরুঙ্গামারী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আলমগীর হোসেন জানান,আমার কাছে কোন চিঠি নেই। প্রশ্নপত্র সমূহে আমরা শুধু স্কড দিয়ে থাকি। বাকি সভাপতি এবং তার দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তারা সটিং, সিলগালা রাখা না রাখা তাদের দায়িত্ব। সাময়িক বরখাস্ত হওয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুর রহমান বলেন,আমাকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। আমি বর্তমানে হসপিটালাইজড আছি এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।
ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মাকে একাধিবার ফোনে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন,বিধি মোতাবেক ইউএনও চিঠি করেছেন। তারপরেও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। ইউএনওকে শোকজ করা হয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন,তাকে জবাব দেবার বলা হয়েছে।
এএজেড