১১ বছর ধরে গুদামে পরিত্যক্ত ১৫৫০ টন ইউরিয়া সার
রংপুর বিভাগে আমন মৌসুমে ইউরিয়া সারের ব্যাপক চাহিদা থাকার পরেও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) পরিচালিত রংপুরের বাফার গুদামে প্রায় ১১ বছর ধরে ফেলে রাখা হয়েছে ১ হাজার ৫৫০ টন ইউরিয়া সার। দীর্ঘদিন এভাবে পড়ে থাকায় বেশির ভাগ সার নষ্ট হয়ে গেছে ও জমাট বেঁধে গেছে।
গুদামে ফেলে রাখা এসব সারের মান ঠিক আছে কিনা এ নিয়ে উদ্বিগ্ন কৃষক। সম্প্রতি কয়েক দফায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্স ১৭৫ টন মানহীন সার সরবরাহ করায় সেই উদ্বেগটা আরও দানা বেঁধেছে।
বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, ইউরিয়া সার সাধারণত নষ্ট হয় না। কোনো কারণে জমাট বেঁধে গেলে তা পুনরায় চূর্ণ করে ব্যবহার করা যায়। তাই নতুন বস্তায় ভরে সারগুলো দ্রুত বাজারে ছাড়া হবে।
আামনের ভরা মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই চলছে ইউরিয়া সারের সংকট। দোকানে দোকানে ঘুরেও সার পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ কৃষকদের। পাওয়া গেলেও কিনতে হচ্ছে অতিরিক্ত দামে। সরকারের পক্ষ থেকে সারের সংকট নেই দাবি করা হলেও ইউরিয়া সারের দাবিতে রংপুরের পীরগঞ্জসহ অনেক জায়গায় কৃষকরা বিক্ষোভ করেছে।
রংপুর কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কৃষিনির্ভর রংপুর জেলায় প্রতি বছর ধান ও আলুসহ সারনির্ভর একাধিক ফসলের চাষাবাদ হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ জেলায় ইউরিয়া সারের চাহিদা রয়েছে ৭৬ হাজার ৩৫ টন। চলতি সেপ্টেম্বরে সারের চাহিদা পীরগঞ্জ উপজেলার বিশেষ বরাদ্দ ৫০০ টনসহ মোট ৬ হাজার ২৮১ টন। এর মধ্যে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়েছে ৩ হাজার ৯৪১ টন। গুদামে মজুদ আছে ১ হাজার ৯০০ টন।
রংপুর বাফার গুদাম সূত্রে জানা গেছে, ২০১১-১২, ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বিপরীতে যে সার সরবরাহ করা হয়েছিল এর মধ্যে ১ হাজার ৫৫০ টন অগ্রহণযোগ্য। কোনো বস্তায় ১০ কেজি, আবার কোনোটিতে ৩৫-৪০ কেজি পর্যন্ত সার কম ছিল। তাই বিষয়টি সমাধানে একাধিকবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তৎকালীন চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের নূর ট্রেডিং কোম্পানিকে অবগত করলেও কোনো সুরাহা হয়নি। তাই দীর্ঘদিন ধরে ইউরিয়া সারগুলো গুদামে অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি বিসিআইসি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে শক্ত, জমাট বাঁধা ও ছেঁড়াফাটা বস্তা ক্রাশ করে নতুন বস্তায় ভর্তি করতে টেন্ডার আহ্বানের জন্য যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। নিয়ম মেনে সেই কাজ পেয়েছে মেসার্স রাজ্জাক অ্যান্ড ব্রাদার্স। এখন পর্যন্ত প্রক্রিয়াজাত করে প্রায় ৮ হাজার বস্তা ভরা হয়েছে।
এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারির জন্য বরাদ্দের ১৭৫ টন সারও নতুন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্স ৮ মাস পর রংপুরের বাফার গুদামে সরবরাহ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নিয়ম অনুযায়ী জাহাজ থেকে খালাসের পর সেগুলো ৫০ দিনের মধ্যে গুদামে সরবরাহের কথা ছিল।
গুদাম সূত্র জানায়, ১১, ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর তিন দফায় সরবরাহ করা ইউরিয়া সারের বস্তা এ সময়ের মধ্যে বিবর্ণ হয়ে গেছে। এ কারণে এর মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
পোটন ট্রেডার্সের প্রতিনিধি মো. মাসুদার রহমান বলেন, পাঁচ-ছয় মাস আগে মোংলা বন্দর থেকে সারের বস্তাগুলো বাঘাবাড়ীতে বিভিন্ন গুদামে ডাম্পিং করে রাখা হয়েছিল। এখানে সরবরাহকৃত সারগুলো শেষের দিকের হওয়ায় বস্তাগুলো লালচে হয়ে গেছে।
অন্যদিকে রংপুর বাফার গুদাম কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন বস্তায় সার ভরে না দিলে তারা তা বিধি অনুযায়ী গ্রহণ করবে না।
রংপুরের বাফার গুদামের উপ-ব্যবস্থাপক ও ইনচার্জ ফয়সাল আহম্মেদ বলেন, আমার আগের ইনচার্জ মুকুল মিয়া দায়িত্বে থাকার সময়ের ঘটনা এটি। মামলার আলামত হিসেবে এটি সংরক্ষণ করা হয়েছিল বলে তিনি জানান।
দীর্ঘ সময়েও এর সমাধান কেন হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। অবশেষে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা সারগুলো নতুন করে বস্তায় ভর্তি করতে অনুমতি পাওয়া গেছে। এখনো বিক্রির অনুমতি পাওয়া যায়নি।
সদ্য সরবরাহকৃত সারের বিষয়ে তিনি বলেন, নতুন বস্তায় সার ভরে দিতে এরই মধ্যে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রসায়ন বিশেষজ্ঞদের মতে, উপাদানগতভাবে ইউরিয়া সার পরিবর্তনশীল। দীর্ঘদিন যদি কোনো গুদামে ইউরিয়া সার ফেলে রাখা হয় তাহলে কিছু ‘সিস্টেম লস’ হতে পারে। ফলে সারের ওজন কমে যেতে পারে। ইউরিয়া সারের অন্যান্য রাসায়নিক পরিবর্তন হওয়ারও শঙ্কা থাকে। এটা নির্ভর করে সারগুলো কোন অবস্থায় কীভাবে রাখা হয়েছে তার উপর। আবার রাসায়নিক উপাদান পরিবর্তিত হওয়া সার ব্যবহারের ফলে ফসলের ক্ষতি হতে পারে।
রংপুর বিভাগীয় গবেষণাগার, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট রংপুরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আইয়ুব-উর-রহমান বলেন, বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের কোনটি কতদিন ভালো থাকবে, তা অবশ্যই উল্লেখ করা থাকে। সারের মেয়াদের বিষয়টি যদিও আমার জানা নেই। ইউরিয়া সার কোনো কারণে জমাটবদ্ধ হয়ে গেলে তা আবার চূর্ণ করে ব্যবহার করলে এর গুণগত মানের কোনো তারতম্য হয় না।
ড. মো. আইয়ুব-উর-রহমানের বক্তব্যের সূত্র ধরে বাফার গুদামের ইনচার্জ মো. ফয়সাল আহম্মেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কতদিন পর্যন্ত ইউরিয়া সার ক্ষেতে ব্যবহার করা যাবে সেটার নির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ উল্লেখ থাকে না।
রংপুর জেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতি এবং জেলা প্রশাসক মো. আসিব আহসান বলেন, ইউরিয়া সার গুদামে থাকার বিষয়টি যখন অবগত হয়েছি তখন থেকেই সেগুলো ব্যবহার উপযোগী কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য বিএসটিআই'কে বলা হয়েছে। বর্তমানে সারগুলো ওজন করা হচ্ছে।
পোটন ট্রেডার্সের সরবরাহকৃত সারের ব্যাপারে তিনি বলেন, সারের মান যাচাই করে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এরই মধ্যে বাফার গুদামের ইনচার্জকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এসজি