পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতি, নদীগর্ভে বিলীন সহস্রাধিক বাড়িঘর
হাজারো মানুষের আহাজারি, মানবন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশেও টনক নড়েনি কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে সহস্রাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভেঙ্গে গেছে চিলমারী ও উলিপুর রক্ষা বাঁধ, পুরান বজরা হাটসহ শতাধিক সরকারি-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। বন্যার পানি ঢুকে প্লাবিত হচ্ছে পুরো এলাকা। তীব্র ভাঙ্গনে যেকোনও মুহূর্তে হারিয়ে যেতে পারে ঐতিহ্যবাহী চিলমারী নদীবন্দর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভাঙ্গন কবলিত এলাকাগুলোতে বরাদ্দ হলেও কাজ হচ্ছে তুলনামুলক কম। বিভিন্ন ভাঙ্গন পয়েন্টে জরুরি বরাদ্দের টাকা নয়-ছয়, বরাদ্দকৃত সাড়ে ছয় কোটি টাকার কাজ না করেই শেষ করার চেষ্টার অভিযোগ স্থানীয়দের। তাদের দাবি, বড় ভাঙ্গনে ফেলা সামান্য জিও ব্যাগ স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের এ ধরনের গাফিলতি ও টেকসই পরিকল্পনা না থাকার কারণেই নদী ভাঙ্গন বেশি হচ্ছে। এতে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। হাজার হাজার একর আবাদি জমি। নি:স্ব হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। দীর্ঘদিন থেকে নদী ভাঙন থাকলেও দীর্ঘমেয়াদী কোনও পরিকল্পনাই নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।
হরিপুর ইউনিয়নের চর মাদারি পাড়া কারেন্ট বাজার এলাকা ঘুরে জানা যায়, জরুরি ভাঙন রোধে এলাকাটির জন্য সাড়ে ছয় কোটি টাকার বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু চার মাসেও কাজ শুরু করতে পারেনি কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড। মূল ঠিকাদার একদিনও এলাকায় আসেননি। মিলন প্রফেসর নামের একজন ব্যক্তি কয়েক হাজার বস্তা বালু ভরে নদীর কিনারে রেখেছেন। মাঝে মাঝে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন আসেন। দেখে যান কিন্তু কাজের অগ্রগতি বিষয়ে কিছু বলেন না।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস সূত্রে জানা গেছে, কাজটি রংপুরের ঠিকাদার আসিবুল হাসান সুজনের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নামে হলেও তিনি কাজটি করছেন না। পানি উন্নয়ন বোর্ড কুড়িগ্রাম অফিস সরাসরি কাজটি তত্ত্বাবধান করছেন। সঙ্গে রয়েছেন স্থানীয় জাতীয় সংসদ সদস্য ব্যারিষ্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তিনি তার বিশ্বস্থ সুন্দরগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক সরদার মিজানুর রহমান মিলনকে দিয়ে প্রকল্প তদারকি করছেন।
ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত কাশিম বাজার এলাকার আব্দুস সবুর বাবু(৬২), পাড়াসাদুয়া এলাকার আলহ্বাজ আজিজুল হক(৭১), মাদারিপাড়া এলাকার গোলজার হোসেন(৮৫) বলেন, ‘কয়েকদিন পর পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন এসে নদী ভাঙন এলাকা দেখে যায়। এমপি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এসে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। গরিব মানুষদের চিড়া-গুড় দিয়ে যান। আমাদের কথা হলো-নদী ভাঙ্গন এলাকার মানুষ তো আর খিদার জ্বালায় মরছেন না, তারা বাপ-দাদার ভিটে হারানোর জ্বালায় মরছেন। আবাদি জমি হারানোর জ্বালায় মরছেন। আমরা চিড়া গুড় চাই না। আর কোন প্রতিশ্রুতিও চাই না। আমরা নদী ভাঙন থেকে টেকসই রক্ষা চাই।’
হরিপুর ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির সহ-সভাপতি মিজানুর রহমান ফরিশ বলেন, ‘আমরা এমপির লোক হওয়ায় কাজটি করতে মিলন সাহেবকে সহযোগিতা করছি। কিন্তু তিনি আমাদের পাওনা নিয়ে নয়-ছয় করছেন। এ নিয়ে তার বাসায় বৈঠক করেছি। কাজটি সঠিকভাবে হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
এদিকে কাজ শুরু হতে না হতেই ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে এমপির লোক মিলনের সঙ্গে হরিপুর ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। জিও ব্যাগ নদীতে ফেলা শুরু না হতেই ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে একাধিক বৈঠকও হয়েছে তাদের। তবে সমঝোতা না হওয়ায় কাজ বন্ধ রয়েছে। যে এলাকাটি রক্ষায় সাড়ে ছয় কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল কর্তৃপক্ষের উদাসিনতা ও কাজ নিয়ে এমপির লোকদের মধ্যে দ্বন্দ্বে সেই এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এতে নতুন করে হুমকির মুখে পড়েছে মাত্র আধা কিলোমিটার দুরে নির্মাণাধীন সাড়ে সাতশ কোটি টাকা ব্যয়ে চিলমারী-হরিপুর তিস্তা ব্রিজ প্রকল্প।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় জাতীয় সংসদ সদস্য ব্যারিষ্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, নদী ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছি। দ্রুত নদী ভাঙন প্রতিরোধে কাজ শুরু করা হবে।
এ সময় কারেন্ট বাজার এলাকায় ভাঙন প্রতিরোধে নিজের লোক দিয়ে কাজ করার ব্যাপারে তিনি বলেন, মূল ঠিকাদার কাজ করছেন। শুধুমাত্র স্থানীয় লোকজন দেখাশোনা করছেন।
এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, লখিয়ার পাড়, মাদারিপাড়া, পাড়া সাদুয়া ও পন্ডিত পাড়া এলাকার নদী ভাঙন প্রতিরোধের কাজ গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। কারেন্ট বাজারের নদী ভাঙন প্রতিরোধের কাজ চলমান রয়েছে। টাস্ক ফোর্স পরিদর্শন করে অনুমোদন প্রদান করলে জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু হবে।
এদিকে নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে নতুন করে ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে, বজরা, কাশিম বাজার, কারেন্ট বাজার, পাত্রখাতা এলাকা। আর নদীর ভাঙন আরো তীব্র হলে এবং বন্যার পানি বৃদ্ধি পেলে কাশিম বাজার, পন্ডিতপাড়া দিয়ে পানি ঢুকে চিলমারী প্লাবিত হবে। অপরদিকে হাসিয়ার ডেরা, ভোলার ছড়ার তীব্র স্রোতেও বাঁধ ভেঙ্গে পানি ঢুকতে পারে চিলমারী। বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের বহুমুখী চাপে হারিয়ে যেতে পারে চিলমারী নদী বন্দর।
এসআইএইচ