ছিটমহল বিনিময়ের ৭ বছর
কেমন আছেন দাসিয়ারছড়াবাসী
মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর জীবন বাঁচাতে পরিচয় গোপন করে নিতে হয়েছে চিকিৎসা! কেউ কেউ নিজস্ব পরিচয় মুছে ফেলে বাংলাদেশি স্বজনদের সহায়তায় চালিয়েছেন পড়ালেখা। ৬৮ বছর ধরে এভাবেই চলতো অবরুদ্ধ জীবন। তখন কুড়িগ্রামের দাসিয়ারছড়া ছিটমহলের বাসিন্দাদের চাওয়া ছিল একটাই- বন্দিদশা থেকে মুক্তি।
৬৮ বছর ধরে ছিল না চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা। আধুনিক ঘরবাড়ি তো দূরের কথা চলাচলের কোনো রাস্তাঘাটই ছিল না। নদী, খাল, ডোবা এমনকি জমির আইলের ওপর দিয়ে মানুষজন কোনোমতে যাতায়াত করত। তবে সেই বন্দিদশা থেকে মুক্তি মিলেছে কুড়িগ্রামের দাসিয়ারছড়া ছিটমহলের বাসিন্দাদের। ছিটমহল বিনিময়ের সাত বছর পূর্ণ হয়েছে। নাগরিকত্ব পাওয়ার পাশাপাশি ছিটমহলবাসীরা পেয়েছেন আধুনিক জীবনযাপনের ছোঁয়া।
আজ ৩১ জুলাই। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময়ের সাত বছর। ২০১৫ সালের এ দিনে মধ্য রাতে দুদেশে থাকা ছিটমহলগুলো স্ব-স্ব দেশের মূল ভূ-খণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। সমাপ্তি ঘটে ১৬২ টি ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের বন্দিদশার। ছিটমহল বিনিময়ের পর থেকেই সেখানকার বাসিন্দাদের মূলধারায় যুক্ত করতে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এ সাত বছরে আমূল পরিবর্তন হয়েছে ছিটমহলগুলোর। যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যসহ সামাজিক নিরাপত্তার মতো নাগরিকের মৌলিক অধিকারের সবকিছুই পূরণ করেছে সরকার। দেশের অভ্যন্তরে অন্যান্য ছিটমহলগুলোর মতো উন্নয়ন ঘটেছে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাশিয়ারছড়া ছিটমহলেও। উন্নয়নের ছোয়ায় পাল্টে গেছে দাসিয়ার ছড়াবাসীর জীবন চিত্র।
অষ্টমতম বর্ষে পর্দাপনে এ ঐতিহাসিক দিনটি ধরে রাখতে বিলুপ্ত ছিটমহলে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। রবিবার (৩১ জুলাই) রাত ১২টা ১ মিনিটে কালিরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ৬৮টি মোমবাতি প্রজ্বালন শেষে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা বলে জানিয়েছেন সাবেক ছিটমহল আন্দোলনের নেতারা।
বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহলের সবচেয়ে বড় দাসিয়ারছড়া। এর আয়তন ৬ দশমিক ৬৫ বর্গ কিলোমিটার কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ারছড়া। ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ শুমারি ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে এখানে ১ হাজার ৩৬৪টি পরিবারের ৬ হাজার ৫২৯ জন মানুষের বসবাস।
প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। ৫৭ কিলোমিটিার নতুন লাইনে সংযোগ দেওয়া হয়েছে ২ হাজারেরও বেশি পরিবারকে। পাকা করা হয়েছে ৪০ কিলোমিটার সড়ক। নির্মাণ হয়েছে পাঁচটি সেতু ও বেশকিছু কালভার্ট। স্থাপিত হয়েছে তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এমপিওভুক্ত হয়েছে চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিক। মসজিদ, মন্দিরসহ রিসোর্স সেন্টার ও ডিজিটাল আইসিটি ট্রেনিং সেন্টার। এ ছাড়া শতভাগ সেচের আওতায় আনা হয়েছে কৃষি জমি। ৩ হাজার ভিজিডিসহ শতভাগ বাড়িতে নিশ্চিত করা হয়েছে সুপেয় পানি ও সেনিটেশন ব্যবস্থা। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি স্থাপন করেছে ১৫টি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র। এ ছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছে ১৪টি মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কেন্দ্র। সেখানকার বাসিন্দাদের দেওয়া হয়েছে ন্যাশনাল আইডি কার্ড ও স্মার্ট কার্ড। এসব উন্নয়নে জীবনচিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে এখানকার মানুষের।
দাসিয়ারছড়া সমন্বয়পাড়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুর ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সরকার আমার ছিটমহলের চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত হওয়ায় আমরা ছিটমহলবাসী চিরকৃজ্ঞ। তাই আমরা ছিটমহলবাসী আজীবন মনে রাখব এ সরকারকে।
ছিটমহলের বাসিন্দা ও কালিরহাট বাজারের মুদি দোকানদার লুৎফর রহমান বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকার আমাদের ৬৮ বছরের অন্ধকার জীবন থেকে সব নাগরিককে মুক্তি দিয়েছে। সরকার আমাদের অনেক উন্নয়ন করেছে। আমার এক ছেলে বিনা টাকায় বিনা সুপারিশে বিজিবিতে চাকরি হয়েছে। শুধু আমার ছেলে না ছিটমহলের অনেকেই আর্মি, বিজিবিসহ ভালো ভালো চাকরি করছে। বাংলাদেশ না হলে এটা সম্ভব হতো না। আমরা এখন গর্বের সঙ্গে বসবাস করছি। তাই যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর দোয়া কামানা করেই যাব।’
বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় বাংলাদেশ অংশের দাসিয়ারছড়া ইউনিটের সভাপতি আলতাফ হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমেই দীর্ঘ ৬৮ বছরের অন্ধকার জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী গত ৭ বছরে ছিটমহলের রাস্তা, ঘাট, ব্রিজ-কালভাট, স্কুল-কলেজ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎসহ ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। আমরা জীবনে ভাবিনি এত উন্নয়নের ছোঁয়া পাব।’
তিনি আরও বলেন, ছিটমহল বিনিময়ের পর বাংলাদেশ থেকে ৬৫টি পরিবারের ১০৭ জন হিন্দু ও ১০০ জন মুসলিম ভারতে যান। আমাদের এ কালিরহাট বাজারে একটি মসজিদ আছে। তার ঠিক ১০০ গজ দূরে একটি বড় মন্দির আছে। যে যার ধর্ম পালন করছে। আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। আমরা মুসলিম-হিন্দু মিলে অনেক ভালো আছি। বর্তমান সরকার আমাদের ভালো রেখেছে। তাই এ সরকারের দীর্ঘ মেয়াদ কামনা করছি।
ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুমন দাস জানান, ছিটমহলে এরই মধ্যে সরকারের নেওয়া পরিকল্পনা বেশিরভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে। আমাদের যুব সমাজ আইসিটি ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছে। সম্প্রতি সরকার ছিটমহলের চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করেছে। কয়েক মাস আগে জমি-ক্রয়-বিক্রয়ে জটিলতা থাকলে সেটিও নিরসন হয়েছে। এখন এখানকার বাসিন্দারা জমি ক্রয়-বিক্রয় করে নিবন্ধনও করতে পারছে।
সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দাদের মূল জণগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে যা যা করার দরকার তার পদক্ষেপ নেবে সরকার এমনটাই জানালেন এই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছিটমহল নিয়ে স্থায়ী সমাধানের জন্য ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের ইন্দিরা গান্ধী ‘মুজিব-ইন্দিরা’ স্থলসীমান্ত চুক্তি সই করেন। এ চুক্তি দীর্ঘ সময় নানা কারণে বাস্তবায়ন না হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হয়। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশ পায় এবং সবচেয়ে বড় ছিটমহল দাসিয়ারছড়া বিলুপ্ত হয়ে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়।
এসএন