ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকা পড়ে অতিষ্ঠ নওগাঁবাসী!
যানজটে আটকা পড়ে অতিষ্ঠ নওগাঁবাসী। ছবি: ঢাকাপ্রকাশ
নওগাঁ জেলা শহরে চলাচল করছে বেশী ভাগ ইজিবাইকের নেই নিবন্ধন। জেলা শহরের পৌরসভায় লাইসেন্সধারী ইজিবাইকের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। এর বাইরে লাইসেন্সবিহীন ইজিবাইক রয়েছে আরও প্রায় সাত হাজার। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে যানবাহন বৃদ্ধি ও অদক্ষ চালক ইচ্ছেমতো চালানোর কারণে শহরের সড়কগুলো ইজিবাইকের দখলে চলে গেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকা পড়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছেন শহরবাসী।
স্থানীয়রা বলছেন, তিন চাকার এসব যানবাহনের কারণে শহরের সড়কগুলো অনিরাপদ হয়ে উঠছে। দুর্ঘটনা আতঙ্ক নিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে পথচারীদের। সড়কে তিন চাকার যানের দাপট নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হচ্ছে না কোনো পদক্ষেপ।
নওগাঁ পৌরসভা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, শহরের আয়তন ৩৮ দশমিক ৪২ বর্গকিলোমিটার। ২০১০ সাল থেকে শহরে চলাচলে ইজিবাইকের লাইসেন্স দেওয়া শুরু করে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৩ হাজার ৮৮৭টি তিন চাকার যানকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের পর থেকে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ ইজিবাইকের লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রেখেছে।
পৌরসভা কার্যালয়ে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী জানান, বর্তমানে শহরে প্রতিদিন ১১ হাজারের অধিক ইজিবাইক চলাচল করে। পৌরসভার নিবন্ধনধারী ইজিবাইকের বাইরে যেসব ইজিবাইক চলাচল করে এগুলোর বেশিরভাগরই নিবন্ধন নেই। বৈধ-অবৈধ ইজিবাইক ছাড়াও সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত গাড়ি, মাইক্রোবাসসহ ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে আরও প্রায় আট হাজার।
নওগাঁ শহরের প্রধান সড়কের দুই পাশে তাজের মোড়, বাটার মোড়, ব্র্রিজের মোড়, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, মুক্তির মোড়, রুবির মোড় ও দয়ালের মোড় এলাকায় গড়ে উঠেছে বড় বড় বিপণিবিতান, ব্যাংক, বিমাসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো। শহরের এসব বাজার এলাকার ভেতর দিয়ে চলে গেছে প্রধান সড়ক। সড়কটির প্রস্থ কোথাও ১৬ ফুট, আবার কোথাও ৮ ফুট। এ সড়ক দিয়ে রিকশা, ভ্যান, ইজিবাইক, অটোরিকশাসহ ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচল করে। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কে কিছুদূর পরপর গড়ে উঠেছে ইজিবাইক ও অটোরিকশার অবৈধ স্ট্যান্ড। ফলে সড়কটি দিয়ে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের। শহরের প্রধান সড়ক ছাড়াও শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড- গোস্তহাটির মোড় সড়ক, ব্রিজের মোড়-ডিগ্রির মোড় সড়কেও তীব্র যানজট লেগে থাকে।
শহরের ওই সব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বাজার এলাকায় কিছুদূর পরপর যানজট লেগে থাকে। রাস্তায় চলা যানবাহনের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই ইজিবাইক। আগে যাওয়ার জন্য একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লেগে থাকে ইজিবাইকগুলো। মানা হয় না কোনো ট্র্যাফিক আইন। অনেক ইজিবাইক এক থেকে দুজনের বেশি যাত্রী পাচ্ছে না। অথচ একটি ইজিবাইকে আটজন যাত্রী বসতে পারে। শহরের তাজের মোড় থেকে মুক্তির মোড় পর্যন্ত প্রধান সড়কের প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকায় কিছুদূর পরপর গড়ে উঠেছে ইজিবাইক ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার অবৈধ স্ট্যান্ড। সড়কের ওপর ইজিবাইক ও অটোরিকশার এসব অবৈধ স্ট্যান্ডের কারণে পুরো রাস্তাই অবরুদ্ধ হয়ে থাকছে।
স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁর সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা আল মেহমুদ ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘শহরে যেসব তিন চাকার যান চলাচল করে তার বেশিরভাগই লাইসেন্সবিহীন। এসব অবৈধ যানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না। এ ছাড়া চালকেরাও অদক্ষ। রাস্তার মধ্যে যেখানে-সেখানে ইজিবাইকগুলো দাঁড় করিয়ে যানজট সৃষ্টি করছে।’
শহরের ব্রিজের মোড় এলাকার কাপড় ব্যবসায়ী নাসির আহমেদ ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘ইজিবাইক ও অটোরিকশাগুলো যেখানে সেখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। সড়কের মোড়গুলোতে গোলচত্বর বা ইউটার্ন না থাকায় যেখানে-সেখানে সড়কের ওপর ইজিবাইগুলো ইচ্ছেমতো ঘোরানো হচ্ছে। এছাড়া সিগন্যাল ছাড়াই হঠাৎ করে রাস্তায় গাড়ি ঘোরানোর ফলে মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ির সঙ্গে প্রায়ই ছোটখাটো দুর্ঘটনা লেগেই আছে। ইজিবাইকচালকদের এসব নিয়ন্ত্রণহীন চলাফেরা নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে মারামারির ঘটনাও ঘটে।’
এদিকে চালকদের দাবি, শহরের ভেতরে ইজিবাইকের কোনো বৈধ স্ট্যান্ড নেই। বৈধ স্ট্যান্ড বা ফাঁকা কোনো জায়গা না থাকায় বাধ্য হয়ে তাঁদের রাস্তার ওপরেই ইজিবাইকগুলো দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়। এ ছাড়া বৈধ ইজিবাইকের বাইরেও শহরে অবৈধভাবে কিছু ইজিবাইক চলাচল করে।
শহরে ইজিবাইক চালান এমন দুজন চালক মিজানুর রহমান ও সাইফুল ইসলাম ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, পৌরসভা থেকে যে পরিমাণ ইজিবাইকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, তার প্রায় দ্বিগুণ ইজিবাইক অবৈধভাবে শহরে চলাচল করে। অবৈধ ইজিবাইকের বিষয়ে কড়াকাড়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শহরে গাড়ির সংখ্যা অনেক কমে যাবে। ফলে যানজট সমস্যাও কমে আসবে।
টানা ১৪ বছর ধরে নওগাঁ পৌরসভার মেয়রের দায়িত্বে রয়েছেন নজমুল হক সনি। যানজট সমস্যার বিষয়ে তিনি ঢাকাপ্রকাশকে জানান, ‘এই শহরের প্রধান সমস্যা হচ্ছে শহরের ভেতর যাওয়া প্রধান সড়কটি প্রয়োজনের তুলনায় সরু। এটা প্রশস্ত না হলে কিংবা শহরের তাজের মোড় থেকে মুক্তির মোড় পর্যন্ত দুই কিলোমিটার এলাকায় ফ্লাই ওভার না হওয়া পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান হবে না। এই শহরে দেড় লাখের বেশি লোকের বসবাস। মানুষের প্রয়োজনেই রাস্তায় যানবাহন চলাচল করে। শহরে যানবাহনের চাপ কমানোর জন্য ২০১৬ সাল থেকে শহর এলাকায় ইজিবাইকের রুট পারমিটের লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু তারপরেও আশপাশের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে লাইসেন্স পাওয়া ইজিবাইক শহরের ভেতর ঢুকে পড়ছে। জেলা প্রশাসন ও পুলিশের সহযোগিতা ছাড়া এসব অবৈধ যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা পৌরসভার একার পক্ষে সম্ভব নয়।’
তবে নওগাঁ শহরের যানজট সমস্যা নিরসনে আশার বাণী শুনিয়েছেন নওগাঁ সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল হক। তিনি ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘নওগাঁ শহরের ভেতর দিয়ে যাওয়া প্রধান সড়কের সান্তাহার ঢাকা মোড় এলাকা থেকে চৌমাশিয়া পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার সড়ক চার লেন করতে একটি প্রকল্প প্রস্তাব সড়ক, পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে প্রকল্পটি ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাশ হয়েছে। আশা করছি, আগামী একনেক সভাতেই প্রকল্পটি অনুমোদন পাবে। শহরের প্রধান সড়কটি চার লেন হলে যানজট সমস্যা অনেকটাই দূর হয়ে যাবে।’