‘পুরুষের চাইতে কম মজুরি পায় চাতালে কর্মরত নারীরা’
ছবি: ঢাকাপ্রকাশ
‘চাতালে রোদে পুড়ে, আগুনের তাপে ও ধুলা-ময়লায় সকাল ৭টা থেকে ৮-৯ ঘণ্টা কাজ করে ১২০-১৩০ টাকা করে মজুরি পাই। কিন্তু পুরুষ মানুষেরা কাজ করে দিনে ৪০০-৫০০ টাকা করে মজুরি পায়। এইগুলো ফারাকের (বৈষম্য) কথা বলতে গেলে কাজই থাকবে না। এমনকি পুরুষের চাইতে চাতালে কর্মরত আমরা নারীরা মজুরি কম পায়। পেটের তাগিদে সব সহ্য করে কাজ করি।
চাতালে কাজ করে অমানবিক ও অবাস্তব মজুরি পাওয়ার কষ্টের কথাগুলো ঢাকাপ্রকাশকে বলছিলেন শিউলী বেগম (৪০) নামের এক নারী শ্রমিক। গতকাল বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) দুপুরে নওগাঁ পৌরসভার লস্করপুর এলাকায় মেসার্স সরস্বতী রাইস মিলে কথা হয় শিউলী বেগমের সঙ্গে।
আজ শুক্রবার (৮ মার্চ) আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিবস উপলক্ষে নারীর অধিকার, মজুরিসহ নানা বিষয়ে সম-অধিকার নিয়ে অনেক সভা-সেমিনার হয়; কিন্তু মজুরি বৈষম্য কমেনি।
শিউলী বেগমের মতো চাতালে নারী শ্রমিকেরা সকাল-সন্ধ্যা পুরুষ শ্রমিকদের মতো কাজ করেন। কিন্তু পুরুষদের তুলনায় তাঁদের মজুরি অর্ধেকেরও কম। এভাবেই বছরের বছর ধরে চালকল কারখানাগুলোতে নারী-পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে মজুরি বৈষম্য চলে আসছে। চাতালে কাজ করা নারীরা ছাড়া কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করা নারীরাও মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন। মজুরি বিষয়ে কথা বলেও তাঁরা কোনো প্রতিকার পান না।
চাতাল শ্রমিকদের দাবি, শ্রম আইন অনুযায়ী মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে মজুরি ঘোষণা করা হোক। নূন্যতম মজুরি ঘোষণা করা হলে চাতাল শ্রমিকদের অমানবিক ও অবাস্তব মজুরি এবং নারী ও পুরুষ শ্রমিকের মধ্যকার মজুরি বৈষম্যের অবসান ঘটবে।
ধান উৎপাদনে প্রসিদ্ধ জেলা হিসেবে পরিচিত দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা নওগাঁয় চাতালে ধান প্রক্রিয়াকরণের ধারা বহুবছরের। জেলা চালকল মালিক গ্রুপ সংগঠনের সূত্র মতে, এ জেলায় ১ হাজার ২০০টি চালকল আছে। এসব চালকলে ৩০ হাজারের ওপর শ্রমিক কাজ করে। এর মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৬০ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করতে পারবেন না বা তাঁকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না। ক্ষেত্রবিশেষে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত শ্রমিক কাজ করতে পারবেন। তবে চাতালে শ্রমিকদের কাজের নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। আইনে নারী শ্রমিকদের রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত কাজ করানো নিষেধ থাকলেও চাতালে নারী শ্রমিকদের বেলায় তা মানা হয় না। নিয়োগপত্র না থাকায়, চাতাল মালিক ইচ্ছে করলেই শ্রমিকদের কাজ থেকে বাদ দিতে পারেন।
নওগাঁ পৌরসভার লস্করপুর এলাকায় অবস্থিত সরস্বতী রাইস মিলের নারী শ্রমিক মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘এখানে কাজ করলে টাকা, না করলে টাকা নাই। কখনো কখনো গভীর রাতে ধান সেদ্ধ শুরু হয়। ওই দিন বাচ্চা কি খাইলো, স্বামী কি খাইলো , বাড়ি কখন যামু তার কিছুই ঠিক থাকে না।’
নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার চৌমাশিয়া এলাকায় মেসার্স রেবেকা রাইস মিলের চাতাল শ্রমিক জুলেখা খাতুন বলেন, ২০০ মণ ধান সেদ্ধ ও শুকালে নগদ ৬০০ টাকা এবং ১১০ কেজি চালের খুদ (ভাঙা চাল) মজুরি হিসাবে দেওয়া হয়। এক চাতাল (২০০ মণ) ধান সেদ্ধ ও শুকাতে আট-নয়জন নারী শ্রমিকের তিন থেকে চার দিন সময় লেগে যায়। আবার ঝড়-বৃষ্টি হলে এক চাতাল ধান শুকাতে সাত-আট দিনও লেগে যায়। এক চাতাল ধান শুকানো হলে নগদ টাকা ও খুদ তাঁরা ভাগ করে নেন। নগদ টাকা ও বাজার অনুযায়ী খুদের দাম অনুযায়ী দিনে তাঁদের ১২০-১৩০ টাকা করে মজুরি পড়ে।
চাতাল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চাতালে মাতৃত্বকালীন ছুটির বালাই নেই। ছুটি চাইলে মালিক কাজ ছেড়ে চলে যেতে বলেন। নারী শ্রমিকদের সঙ্গে থাকা ছোট সন্তানদের জন্যও নেই কোনো সুযোগ-সুবিধা।
নওগাঁ জেলা ধান্য বয়লার ও অটো সাটার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোজাফফর হোসেন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, চাতালে আট থেকে নয়টি স্তরে শ্রমিকদের কাজ করতে হয়। ট্রাক থেকে ধান নামানো, গুদামজাতকরণ, ধান সেদ্ধ করা, শুকানো, চাল প্রক্রিয়াকরণ, চাল বস্তায় ভরা, বস্তার মুখ সেলাই করাসহ সব কাজই করতে হয় চাতালশ্রমিকদের। এর মধ্যে নারী শ্রমিকেরা ধান সেদ্ধ করা ও শুকানোর কাজ করে থাকে।
চাতাল শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘চাতাল শ্রম আইনের অন্তর্ভুক্ত একটি শিল্প। কিন্তু এ খাতে শ্রম আইনের একটি ধারাও মানা হয় না। চাতালের শ্রমিকেরা শ্রমিক হিসেবেই স্বীকৃত নন। আমরা দীর্ঘদিন ধরে চাতালে কর্মরত মানুষদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি এবং তাঁদের জন্য নূন্যতম মজুরি ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছি। নূন্যতম মজুরি না থাকায় একেক চালকল চালকল একেক রকম মজুরি দিচ্ছে। কোথাও একজন শ্রমিক দিনে ১০০ টাকা, কোথাও ১৫০ টাকা আবার কোথাও ৩০০ টাকা পেয়ে থাকেন। চাতালে নারী শ্রমিকেরা তো যে মজুরি পান সেটা অমানবিক ও অবাস্তব। বর্তমান বাজারে এই মজুরি দিয়ে জীবন নির্বাহ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) নওগাঁ জেলা শাখার সভাপতি ও নওগাঁ জজ কোর্টের আইনজীবী মহসিন রেজা ঢাকাপ্রকাশকে জানান, ‘চাতাল শিল্পের প্রতি সরকারের কোনো নজরদারি না থাকায় এ শিল্পে কর্মরত শ্রমিকেরা দিনের পর দিন মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে। নওগাঁতে শ্রমিক ও চালকল মালিকপক্ষের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী প্রতি তিন বছর পর পর চালকল কারখানার শ্রমিকদের মজুরি সমন্বয় হওয়ার কথা। সর্বশেষ ২০১৫ সালে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি হয়। সেই চুক্তির মেয়াদ ২০১৮ সালে শেষ হলেও এখন পর্যন্ত চালকলের শ্রমিকদের মজুরি সমন্বয় করা হয়নি। অথচ এই সময়ের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। অবিলম্বে এই শিল্পের শ্রমিকদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া ও নূন্যতম মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা উচিত।’