যে কারণে নওগাঁর তিন আ.লীগ সংসদ সদস্যের নির্বাচনে ভরাডুবি
নওগাঁর তিন আ.লীগ সংসদ সদস্যের নির্বাচনে ভরাডুবি। ছবি: ঢাকাপ্রকাশ
নওগাঁ-৪ (মান্দা) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য (এমপি) ইমাজ উদ্দীন প্রামাণিক দলের মনোনয়ন না পেয়ে এবার নির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তিনি ভোট পেয়েছেন ১১ হাজার ১৯০ ভোট। নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী, প্রদত্ত ভোটের আট ভাগের এক ভাগ ভোট না পাওয়ায় তিনি জামানত খোয়াতে যাচ্ছেন।
ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিকের মতো দল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নৌকার প্রার্থীর কাছে বড় ব্যবধানে হেরে গেছেন নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর ও বদলগাছী) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দিন তরফদার। অন্যদিকে নৌকা নিয়ে নির্বাচন করেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে গেছেন নওগাঁ-৬ (রাণীনগর ও আত্রাই) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন।
নির্বাচনের পর নওগাঁর পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ও জনবিচ্ছিন্ন থাকার কারণে ওই তিন সংসদ সদস্যের নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে।
ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে নওগাঁ-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম ব্রহানী সুলতান মামুদ ৮৫ হাজার ১৮০ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে ভোট পেয়েছেন ৬২ হাজার ১৩২ ভোট। ওই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য স্বতন্ত্র (ঈগল) প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে ভোট পেয়েছেন ১১ হাজার ১৯০ ভোট। ছয়বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ইমাজ উদ্দীন এ ধরণের ফলাফলকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটাররা ভরাডুবি হিসেবে দেখছেন। তবে সংসদ সদস্য ইমাজ উদ্দিন ও নৌকার প্রার্থী নাহিদ মোর্শেদ পরাজিত হওয়ায় কেউই বিস্মিত নন। বরং অনেকে জোর দিয়ে বলেছেন, কাঙ্ক্ষিত রায় পেতে ভোটারদের অপেক্ষার অবসান হয়েছে।
মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন মন্ডল বলেন, ‘বর্তমান সংসদ সদস্য ইমাজ উদ্দীন প্রামাণিক একজন বর্ষীয়ান নেতা। তিনি মান্দা থেকে ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে তিনি জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এক সময় তিনি এ অঞ্চলের প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তবে বর্তমানে তার বয়স ৮০-এর ওপরে। বয়স ও অসুস্থতার কারণে গত পাঁচ বছর ধরে এলাকার জনগণকে তেমন সময় দিতে পারেননি। বেশিরভাগ সময় ঢাকায় অবস্থান করার কারণে স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গেও তাঁর একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। নির্বাচনে তাঁরই প্রভাব পড়েছে। তবে এত কম ভোট পাবেন এটা আশা করেনি।’
স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক ব্রহানী সুলতান মামুদের পক্ষে ছিলেন আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্মদ বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য শফিকুর রহমান মামুন। তিনি বলেন, ‘ব্রহানী সুলতান মামুদ তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন নেতা। তিনি পরিচ্ছন্ন একজন রাজনৈতিক। তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই। দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির মাঠে থাকায় এবং জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় তাঁর জয়টা অনেকটাই অনুমেয় ছিল। অন্যদিকে নৌকার প্রার্থী ও মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাহিদ মোর্শেদ দলের পদ ব্যবহার করে অনেক অনিয়ম করেছেন। ভোটে তারই প্রভাব পড়েছে।’
নওগাঁ-৩ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সাবেক আমলা সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ১ লাখ ৩৮ হাজার ৫৬১ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র হিসেবে ট্রাক প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বর্তমান সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দিন তরফদার পেয়েছেন ৬০ হাজার ৫১ ভোট। ছলিম উদ্দিন তরফদার ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সৌরেন্দ্রনাথের পক্ষে ছিলেন মহাদেবপুর উপজেলার রাইগাঁ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আরিফুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ছলিম উদ্দিন তরফদার, তাঁর ছেলে সাকলাইন আহমেদ, ভাগনে শাকিল আহমেদের বিরুদ্ধে অনেক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ছলিম উদ্দিন ও তাঁর স্বজনদের অনিয়ম-দুর্নীতির খবর এলাকার প্রায় সবাই জানে। এটা ভোটে ভরাডুবি হওয়ার প্রধান কারণ।’
নওগাঁ-৬ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ওমর ফারুকের কাছে ৬ হাজার ৭৫৬ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী ওমর ফারুক ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে পেয়েছেন ৭৬ হাজার ৭১৭ ভোট। নৌকার প্রার্থী আনোয়ার হোসেন পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭১ ভোট। সাবেক সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলমের মৃত্যুতে নওগাঁ-৬ আসন শূণ্য হলে ২০২০ সালে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জয়ী হন আনোয়ার হোসেন।
আত্রাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি চৌধুরী গোলাম মোস্তফা বলেন, আনোয়ার হোসেন মাত্র তিন বছর সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই তিন বছরেই তাঁর বিরুদ্ধে অনেক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এই সময়ের মধ্যে তাঁর ছেলে-মেয়েরা শূন্য থেকে কোটিপতি বনে গিয়েছেন। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণেই মানুষ তাঁকে আর বেছে নেননি। অন্যদিকে ওমর ফারুক সুমন রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা ওহিদুর রহমান রাণীনগর-আত্রাইয়ের সাবেক সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি সব সময়ই মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এছাড়া এবার ভোটে আঞ্চলিকতা একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। আত্রাই উপজেলার মানুষ হিসেবে ওমর ফারুক আত্রাইয়ের ভোটকেন্দ্রগুলোতে বেশি ভোট পেয়েছেন। আর রাণীনগরে বেশি ভোট পেয়েছেন আনোয়ার হোসেন।
অন্যদিকে নওগাঁ-১ (নিয়ামতপুর, পোরশা ও সাপাহার) আসনে চতুর্থবারের মতো জয় পেয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। ১ লাখ ১০ হাজার ১৭১ ভোটের বিশাল ব্যবধানে তিনি জয়ী হয়েছেন। সাধন চন্দ্র মজুমদারের প্রাপ্ত ভোটের পরিমান ১ লাখ ৮৬ হাজার ৯০০ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র (ট্রাক) প্রার্থী খালেকুজ্জামান তোতা পেয়েছেন ৭৬ হাজার ৭২৯ ভোট।
নওগাঁ-৫ (নওগাঁ সদর) আসনে স্বতন্ত্র (ট্রাক) প্রার্থী দেওয়ান ছেকার আহমেদকে ৫১ হাজার ৭৮৭ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন নিজাম উদ্দিন জলিল। সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন জলিল পেয়েছেন ১ লাখ ৪ হাজার ৬৭১ ভোট। আর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান ছেকার আহমেদ পেয়েছেন ৫২ হাজার ৮৮৪ ভোট।
উল্লেখ্য, আজ মঙ্গলবার (৯ জানুয়ারি) দুপুরে নওগাঁ জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং অফিসার মো. গোলাম মওলা স্বাক্ষরিত এক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। ওই গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮ টা হতে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ব্যালট পেপারের স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনি এলাকা ৪৭, নওগাঁ-২ আসনের বৈধভাবে মনোনীত প্রার্থীর মৃত্যুজনিত কারণে গত ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন ওই আসনের ভোট স্থগিত করে।