নওগাঁয় সরিষা উৎপাদনের সাথে বাড়ছে মধু আহরণ
মৌচাষের জন্য সরিষা খেতের পাশে বসানো হয়েছে মৌ-বাক্স। ছবি: সংগৃহীত
নওগাঁর বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন সরিষা ফুলের হলুদ রঙের সমারোহ। চলতি মৌসুমে জেলার প্রায় প্রতিটি মাঠ এখন সরিষা ফুলের মৌ মৌ গন্ধে মুখর। যেদিকে চোখ যায় শুধু সরিষা ফুলের হলুদ রঙের চোখ-ধাঁধানো বর্ণিল সমারোহ। এর পাশেই মৌ-বক্স বসিয়েছেন মৌ চাষিরা। এতে মৌমাছির মাধ্যমে সর্ষে ফুলের পরাগায়নে সুবিধা হচ্ছে। পরাগায়নের ফলে একদিকে সর্ষের উৎপাদন বাড়ছে, অন্যদিকে মধু আহরণ করা হচ্ছে। সমন্বিত এই চাষে সরিষা চাষি ও মৌচাষি-দুই পক্ষই লাভবান হচ্ছে। শুধু মধু উৎপাদন করেই এ মৌসুমে আয় হতে পারে ১০ কোটি টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁ জেলা কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ জেলায় কৃষকদের দিন দিন সরিষা চাষে আগ্রহ বাড়ছে। পাঁচ বছরে জেলায় সরিষার আবাদ বেড়েছে দিগুনেরও বেশি। জেলার ১১টি উপজেলায় এ বছর সরিষার চাষ হয়েছে ৬৮ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে, যা গত বছরের তুলনায় ২০ হাজার ৬৫০ হেক্টর বেশি। গত বছর জেলায় সরিষার আবাদ হয়েছিল ৪৭ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। ২০২১ সালে সরিষার আবাদ হয়েছিল ৩৬ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে, ২০২০ সালে ৩১ হাজার ১৭৫ হেক্টর এবং ২০১৯ সালে সরিষা চাষ হয়েছিল ৩০ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে। এই হিসাবে গত পাঁচ বছরে জেলায় সরিষার আবাদ বেড়েছে ৩৭ হাজার ৭০০ হেক্টর জমি। এবার চাষ হওয়া ৬৮ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমি থেকে ১ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ।
স্থানীয় কৃষক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির কারণে কৃষকেরা গত দুই-তিন বছর ধরেই শর্ষে চাষে ঝুঁকছেন। এবার গত বছরের তুলনায় ২০ হাজার হেক্টরের বেশি পরিমাণ জমিতে সরিষার আবাদ করেছেন। এ ছাড়া গত মৌসুমে শর্ষের ভালো দাম ছিল। চলতি বছর বেশি পরিমাণ জমিতে সরিষা চাষ হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, এবার বর্ষায় বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। ফলে জেলার বিভিন্ন এলাকায় নিচু জমিগুলো থেকে এবার আগেই পানি নেমে গেছে। ওই সব জমি বোরো আবাদের জন্য দুই-তিন মাস ধরে ফেলে না রেখে কৃষকেরা সেখানে সরিষা চাষ করেছেন। ফসল ঘরে উঠতে সময় লাগে জাত ভেদে ৭০ থেকে ৯০ দিন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, নওগাঁর বিভিন্ন উপজেলায় এবার বিভিন্ন মাঠে সরিষা খেতের পাশে গত শুক্রবার (২২ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ৮ হাজারের অধিক মৌ-বক্স স্থাপন করা হয়েছে। এই পরিমাণ বক্স থেকে এবার ২০০ মেট্রিক টন মধু সংগ্রহ করা হবে বলে ধারণা করছে কৃষি বিভাগ। প্রতি কেজি মধু ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এবার জেলায় শর্ষের ফুল থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকার মধু সংগ্রহ হতে পারে বলে ধারণা করছেন কৃষি কর্মকর্তা ও মৌচাষিরা।
সূত্রটি আরও জানায়, চলতি বছর জেলায় সবচেয়ে বেশি ৭ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে শর্ষে চাষ হয়েছে মান্দা উপজেলায়। ফলে এ উপজেলার মাঠে মাঠে মৌচাষিদের আনাগোনাও বেশি। মান্দা উপজেলার কালিকাপুর, ভারশো ও তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের বেশ কিছু ফসলের মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, মাঠগুলোর প্রায় ৭০ শতাংশ জমিজুড়েই সরিষার আবাদ হয়েছে। এসব মাঠে সরিষা খেতের পাশে মৌ-বক্স বসিয়েছেন খামারিরা (মৌচাষিরা)। তাঁরা রাজশাহী, সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলা থেকে এসেছেন। কেউ কেউ অন্য এলাকা থেকে এসেছেন। মান্দার বিভিন্ন এলাকায় ২২ জন মৌ খামারি ৪ হাজার বক্স নিয়ে এসেছেন মধু সংগ্রহ করতে। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ের মৌচাষিরাও মধু সংগ্রহ করছেন।
গত শনিবার (২৩ ডিসেম্বর) নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের জয়বাংলা মোড় এলাকায় মান্দা উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের ছোট মল্লুকপুর মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের পাশে মহাসড়ক সংলগ্ন একটি আম বাগানে ৫০০টি মৌ-বক্স স্থাপন করেছেন মৌচাষি আবুল কালাম আজাদ। রাজশাহীর কেশরহাট উপজেলা থেকে তিনি এসেছেন মধু সংগ্রহের জন্য।
আবুল কালাম আজাদ বলেন, দুই সপ্তাহ হলো তিনি ওই মাঠে মধু সংগ্রহের জন্য বক্স বসিয়েছেন। এ পর্যন্ত তিনি ৫০০টি বক্স থেকে দুবার মধু সংগ্রহ করেছেন। প্রতিবার একটি বক্স থেকে আড়াই থেকে তিন কেজি মধু পাওয়া গেছে। গত পাঁচ বছর ধরেই নওগাঁর বিভিন্ন এলাকায় রবি মৌসুমে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসজুড়ে শর্ষে খেতের পাশে মৌ-বক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করে আসছেন।
মান্দার পরেই জেলায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শর্ষে চাষ হয়েছে নিয়ামতপুর উপজেলায়। নিয়ামতপুরে এবার সরিষার আবাদ হয়েছে ৬ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে। নিয়ামতপুর উপজেলার কয়াশ গ্রামের একটি মাঠে ৮০টি বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন মান্দা উপজেলার ভালাইন এলাকার সাইদুর রহমান। তিনি স্কুল শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাকের সরিষা খেতের পাশে বাক্স বসিয়েছেন।
আব্দুর রাজ্জাক জানান, সরিষা খেত থেকে মধু আহরণ করলে পরাগায়ন হয়। এতে উৎপাদন বাড়ে। তাই তিনি ও আশপাশের জমির মালিকেরা মৌচাষিদের উৎসাহিত করছেন।
নিয়ামতপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কামরুল আহসান বলেন, ‘মৌমাছি শর্ষের ফুলে উড়ে উড়ে বসে মধু সংগ্রহ করে। এতে শর্ষে ফুলে সহজে পরাগায়ন ঘটে। শর্ষে খেতে ফুল যত বেশি হবে শর্ষের উৎপাদনও তত বেশি হবে। শর্ষে খেতের পাশে মৌ চাষের বক্স স্থাপন করলে শর্ষের ফলন অন্তত ১০ শতাংশ বাড়ে। পাশাপাশি মৌচাষিরা মধু আহরণ করে লাভবান হন।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁর উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘মৌমাছির মাধ্যমে বক্স পদ্ধতিতে মধু আহরণ করে কৃষি খাতে ১০ থেকে ২০ শতাংশ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। বিশেষ করে সরিষা, কালিজিরা, আম ও লিচু উৎপাদনের ক্ষেত্রে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের কৃষকের ধারণা এখনও স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে প্রচারণার পাশাপাশি মৌচাষে উৎবুদ্ধ করতে খামারিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া অনেক মৌচাষিকে কৃষি বিভাগ থেকে মৌ-বাক্স ও রাণী মৌমাছিও সরবরাহ করা হচ্ছে।’