‘কলেজটিকে বাপ-দাদার সম্পত্তি মনে করেন অধ্যক্ষ’
নওগাঁর আত্রাই উপজেলার সিংসাড়া কছির উদ্দিন দেওয়ান মেমোরিয়াল হাইস্কুল ও কলেজ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, নিয়োগ-বাণিজ্য, সভাপতির জাল স্বাক্ষর, শিক্ষক-কর্মচারীদের হয়রানি ও অসৌজন্যমূলক আচরণসহ নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা যায়,লুটপাটসহ বিভিন্ন খাতের ফি বৃদ্ধি করে সেই অর্থ আত্মসাৎ,খাতা, কলম, কাগজ, ভবন নির্মাণ ও সংস্কার, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগসহ নানা দুর্নীতিতে জড়িত কলেজটির অধ্যক্ষ ফরিদুল ইসলাম রতন। এসব বিষয়ে প্রতিবাদ জানাতে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের আয়োজনে শুক্রবার (১০ মার্চ) বিকালে ওই কলেজ মাঠে সুধী সমাবেশ করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটির অ্যাডহক কমিটির প্রধান মারিয়া সালামের সভাপতিত্বে সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন আত্রাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব এবাদুর রহমান এবাদ। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নৃপেন্দ্রনাথ দত্ত দুলাল, সাধারণ সম্পাদক আক্কাস আলী, সাবেক সভাপতি দেওয়ান মেহেদী হাসান তমাল প্রমূখ।
সমাবেশে শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ এলাকাবাসী অভিযোগ করে বলেন, অধ্যক্ষ ফরিদুল ইসলাম রতন সঠিক সময়ে প্রতিষ্ঠানে আসেন না। আর আসলেও তার ব্যক্তিগত কাজ শেষ করে দ্রুত চলে যান। কলেজটিকে বাপ-দাদার সম্পত্তি মনে করেন অধ্যক্ষ। তার ইচ্ছা মতো প্রতিষ্ঠানের বেতন বৃদ্ধি এবং ফি আদায় করেন।
মাধ্যমিক স্তরের বেশকিছু ছাত্র-ছাত্রী জানায়,তাদের অনুষ্ঠিত ২০২২ সালের অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষায় প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ প্রশ্নপত্র কিনে নিয়ে এসে পরিক্ষা নেন। তাদেরকে যা পড়ানো হয়েছে প্রশ্নপত্রে তা কমন ছিল না। বিষয়টি অধ্যক্ষকে জানালে ‘তিনি বলেন,পারলে পরীক্ষা দাও না পারলে চলে যাও’।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে এবাদুর রহমান বলেন, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যাবত নানা অনিয়মের অভিযোগ শুনে আসছি। আমরা চাই, এসব অনিয়মের সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে তাকে অপসারণ করা হোক। এ রকম ব্যক্তির দ্বারা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হতে পারে না। এই স্কুলের সুনাম ফিরিয়ে আনতে আমরা সব ধরনের পদক্ষেপ হাতে নিব।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে নৃপেন্দ্রনাথ দত্ত দুলাল বলেন, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মারাত্মক সব অভিযোগ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম উনি নিজের সুবিধা হাসিলে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে রেখেছেন। জনাব ইউনুস আলী দেওয়ান এবং তার ভাই মহসিন আলী দেওয়ান স্থানীয়দের সহায়তায় এই গ্রামে এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করেছিলেন এবং উনাদের জীবদ্দশায় এই প্রতিষ্ঠান এলাকায় শিক্ষা বিস্তারে অত্যন্ত সুনাম অর্জন করে। পরবর্তীতে এই অধ্যক্ষ এবং তার শিক্ষকদের অবহেলায় এটি তার গৌরব হারিয়েছে। স্কুলে শৃঙ্খলা বলতে কিছুই নাই। আমরা বুঝেছি এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ এবং শিক্ষকরা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এই অবস্থায় আপনারা এলাকাবাসী এবং অবিভাবকরা শক্ত অবস্থান নিন এবং যথাযথ দাপ্তরিক পদক্ষেপ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে পূর্বের গৌরবময় অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যান। আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।
এ প্রসঙ্গে স্কুলটি প্রতিষ্ঠায় অন্যতম উদ্যোগী এবং স্থানীয় শিক্ষানুরাগী খয়বর খান বলেন, এই স্কুলের প্রথম অনুদান আমি সুপারিশ করে এনে দিয়েছিলাম। আমাদের রক্তে মাংসে গড়া এই প্রতিষ্ঠানে যখন দেখি একটা বা দুইটা ক্লাস করেই শিক্ষার্থীরা বাড়ি চলে যাচ্ছে, কোনো অনুশাসন নাই তখন কষ্টে মন ভেঙে যায়। সরকারের টাকা নিয়ে দায়িত্ব পালন না করাটাও একটা দুর্নীতি। এ রকম দুর্নীতিবাজ শিক্ষকদের হাতে আমাদের সন্তানরা কতটা নিরাপদ? আমরা এসবের বিহিত চাই এবং এই অযোগ্য অধ্যক্ষের হাত থেকে মুক্তি চাই।
এ বিষয়ে স্কুলটির ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি দেওয়ান মেহেদী হাসান তমাল জানান, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানাবিধ অনিয়মের অভিযোগ আছে। আমি করোনাকালীন সভাপতি ছিলাম বিধায় পাঠদানের পরিবেশ নিয়ে কোনো অনিয়ম লক্ষ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে, এলাকাবাসীর অভিযোগের ভিত্তিতে আমি মৌখিকভাবে বহুবার উনাকে সতর্ক করে কোনো ফল পাইনি। এক পর্যায়ে আমি বেতন বিলে সাক্ষর করা বন্ধ করে দিলে উনি আমার সাক্ষর জাল করে বেতন তুলেন।
তিনি আরও জানান, এর আগেও পূর্বের সভাপতির সাক্ষর জাল করে নিয়োগ দেওয়ায় উনার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। সেই মামলায় উনি প্রায় দুই বছর জেলে ছিলেন, বর্তমানে সেই মামলা চলমান। এ রকম শিক্ষকের কাছে ছাত্র-ছাত্রীরা কি শিখবে? আমাদের প্রতিষ্ঠানে এ রকম শিক্ষক আমরা চাই না।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অ্যাডহক কমিটির সভাপতি মারিয়া সালাম জানান, নিজেই ইচ্ছে মতো সব কিছু করতে চান অধ্যক্ষ। আমি তাকে স্কুলের পরিবেশ ভালো করতে অনুরোধ করায় উনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেন এবং আমার নামে নানারুপ নোঙরা কথা ছড়াতে থাকেন। একজন অধ্যক্ষের এ রকম আচরণ মোটেই গ্রহনযোগ্য নয়। উপরন্তু উনি প্রতিষ্ঠানে চলমান দুর্নীতি গোপন করতে আমাকে আমার দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান করতে বিভিন্ন অবৈধ পন্থা হাতে নিয়েছেন। আর দুর্নীতি গোপন করার কৌশল উদ্ভাবনের পেছনে সময় দিতে গিয়ে উনি ও উনার শিক্ষকমণ্ডলী পাঠদানে সময় দিতে পারছেন না। সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে এর একটা সমাধান প্রয়োজন।
তিনি আরও জানান, আমরা প্রাথমিকভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং চেয়ারম্যান, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, রাজশাহী বরাবর একটি আবেদন জমা দিয়েছি। দ্রুতই চুড়ান্ত অভিযোগপত্র জমা দিব আমরা।
এদিকে স্কুলের সাবেক এক শিক্ষকের ছেলে সুমনের অভিযোগ, তার পিতার পদে তাকে চাকরি দেওয়ার নাম করে অধ্যক্ষ রতন ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেও তার চাকরি হয়নি। এ ব্যাপারে সে লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ইতিমধ্যে অভিযোগ জানিয়েছে।
স্থানীয়দের দাবি, প্রতিষ্ঠানটি আজ এর ঐতিহ্য আর ছাত্র ছাত্রীদের পড়ালেখার পরিবেশ হারিয়েছে । ছাত্র-ছাত্রীরা পড়ালেখার পাশাপাশি অশ্লীল কাজে বেশি লিপ্ত হয়ে পড়েছে।
এক অবিভাবক আক্ষেপ করে বলেন, আজ এই স্কুলের নাম হয়েছে প্রেমের স্কুল। আমরা আমাদের মেয়েদের এখানে পড়াতে চাচ্ছি না সম্মানের ভয়ে।
আর অধ্যক্ষ রতন নিজেই যেখানে তার ছাত্রীকে বিয়ে করেছেন সে প্রতিষ্ঠানের নৈতিক পরিবেশ কেমন হতে পারে-এই প্রশ্ন করেছেন অনেকেই।
জানা যায়, কারো অবর্তমানে ক্লাস নিতে গেলে অধ্যক্ষ তার লাইফ হিস্ট্রি, তিনি কতটা প্রেম করেছেন, কিভাবে বিয়ে করেছেন-এসব আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে অধ্যক্ষ ফরিদুল ইসলাম রতন বলেন, আমার বিষয়ে আনিত সকল অভিযোগ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। আমার বিরুদ্ধে লিখিত কোনো অভিযোগের বিষয়ে আমার জানা নেই।
এ ব্যাপারে জেলা শিক্ষা অফিসার লুৎফর রহমান জানান, আমি এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে লিখিত কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসআইএইচ