বেড়েছে বিবাহ বিচ্ছেদ, উদ্বেগ সচেতন মহল
জয়পুরহাটে জেলায় বিগত ২০২২ সালে এক বছরে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) যে সংখ্যক বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে, বিচ্ছেদের (তালাক) ঘটনা ঘটেছে তার অর্ধেকের চেয়েও বেশি। এ নিয়ে জেলায় সচেতন মহল উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মোটাদাগে বিয়ে বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে যৌতুক, পরকীয়া এবং স্বামীর মাদকাসক্তিকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও অনুসন্ধানে বিয়ে বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে বাল্য বিয়ে, দীর্ঘদিন স্বামীর প্রবাসে থাকা, শ্বশুর, শাশুড়ির নির্যাতন ইত্যাদি কারণের কথাও জানা গেছে।
জয়পুরহাট জেলা রেজিস্টারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ জেলায় গত এক বছরে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে ৫ হাজার ২৬০ টি। আর বিয়ের পরে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ৭৩৬টি। এর মধ্যে স্বামী কর্তৃক তালাক হয়েছে ৭৭৩টি, স্বামী-স্ত্রী উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে তালাকের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৪৯২টি আর স্ত্রী কর্তৃক তালাকের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৪৭১টি।
জয়পুরহাট জেলা রেজিস্টার সহকারী আব্দুল খালেক বলেন, 'গত ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে বিয়ে বিচ্ছেদের হার দাঁড়িয়েছে ৭১ শতাংশে। অথচ ২০১৯-২০ এবং ২১ সাল পর্যন্ত এই বিয়ে বিচ্ছেদের হার ৪৫ থেকে ৫১ শতাংশের মধ্যেই ছিল। তাই গত এক বছরের বিয়ে বিচ্ছেদের হার সত্যিই উদ্বেগ জনক।'
জেলার কালাই উপজেলার আহাম্মেদাবাদ ইউনিয়নের কাজী মুনছুর রহমান জানান, তাঁর ইউনিয়নে ২০২১ সালে মোট বিয়ে হয়েছে ১৪২টি। এরমধ্যে স্বামী কর্তৃক তালাক হয়েছে ১৪টি, স্বামী-স্ত্রী উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে তালাকের ঘটনা ঘটেছে ২১টি আর স্ত্রী কর্তৃক তালাকের ঘটনা ঘটেছে ২৩টি; আর ২০২২ সালে মোট বিয়ে হয়েছে ১২২টি।
এরমধ্যে স্বামী কর্তৃক তালাক হয়েছে ৫টি, স্বামী-স্ত্রী উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে তালাকের ঘটনা ঘটেছে ২৪টি আর স্ত্রী কর্তৃক তালাকের ঘটনা ঘটেছে ২৬টি। বিয়ের রেজিস্ট্রি এবং তালাক উভয় ক্ষেত্রে কাজীর প্রয়োজন হয়। জয়পুরহাট জেলার ৫টি পৌরসভা এবং ৩২টি ইউনিয়নে মোট কাজী আছেন ৩৭ জন। এই কাজীদের মধ্যে ৭ জনের সাথে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের।
জয়পুরহাট সদর উপজেলার দোগাছি ইউনিয়নের (বিবাহ রেজিস্টার) কাজী আব্দুল ওয়াদুদ এবং জামালপুর ইউনিয়নের কাজী আব্দুল হান্নান জানান, যোতুক, বাল্য বিয়ে, স্বামীর দীর্ঘদিন বিদেশে থাকা ও স্ত্রীর খোঁজ খবর না রাখা, স্বামীর মাদকাসক্তি, মোবাইল ঘটিত পরকীয়া প্রেম, স্বামীর অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা, স্ত্রীর উচ্চ আকাঙ্ক্ষা, শাশুড়ি কর্তৃক নির্যাতন ইত্যাদি কারণে এ জেলায় বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। তাঁরা আরও জানান, আগে স্বামী কর্তৃক তালাক দেওয়ার সংখ্যা বেশি ছিল। কিন্তু বর্তমানে স্ত্রী কর্তৃক তালাক দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। বাকী পাঁচজন কাজীদের মন্তব্যও অনুরূপ।
জেলার 'সরকারি ছাঈদ আলতাফুন্নেছা কলেজে'র সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক তানজির আহমেদ সাকিব বলেন, 'আগের চেয়ে বর্তমান সময়ে বিয়ে বিচ্ছেদের প্রবণতা কিছুটা বেড়েছে। মোটা দাগে এর কারণ হিসেবে অসময়ের বিয়ে বা বাল্য বিয়েকে চিহ্নিত করা যায়। যার বেশিরভাগ সংঘটিত হয়েছে মহামারী করনাকালে। এরই নেতিবাচক প্রভাবে স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের লেখাপড়া ব্যাহত হওয়ায়, পিতামাতারা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে দিয়েছেন অসময়ের বিয়ে।
যার ফলশ্রুতিতে সুন্দর আগামী নষ্ট হয়েছে অনেকের। তাছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশে স্মার্টফোনের ব্যবহার বেশি হওয়ায়, ছেলেমেয়েরা টিনেজ বয়সে পড়াশোনার পরিবর্তে প্রেমে আসক্ত হয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন আবেগ তাড়িত হয়ে। এসব দিয়ে বেশিদিন টেকসই হয়নি, ঘটেছে বিচ্ছেদের ঘটনা। এছাড়াও স্বামী স্ত্রীর মধ্যে নানা কারণে বনি-বনা না হওয়া, পরকীয়া, যৌতুক ইত্যাদি কারণেও সমাজে দিন দিন বিয়ে বিচ্ছেদের প্রবণতা বাড়ছে।'
জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাবিনা সুলতানা বলেন, 'বাল্য বিয়ে, মোবাইল বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরকীয়া প্রেম, যৌতুক, স্ত্রীর স্বামীর উপার্জনে সন্তুষ্ট না থাকা,স্বামীর মাদকাসক্ততা এবং স্ত্রীর প্রতি উদাসীন থাকা ইত্যাদি কারণে ইদানিং বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা সমাজে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিয়ে বিচ্ছেদের প্রবণতা কমানোর জন্য প্রথমেই সকলকে সচেতন হতে হবে, বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। সেই সাথে ধর্মীয় জ্ঞানের চর্চা করে ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।'
জয়পুরহাটে জেলা রেজিস্টার (ডিআরও) শরীফ তোরাফ হোসেন জানান, জয়পুরহাট জেলায় যৌতুক প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। লোভী মানুষেরা যৌতুকের কারণে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন। চুক্তিলব্ধ যৌতুক পাওয়ার পর, অনেকের লোভ আরও বেড়ে যায়। তাঁরা আরও বেশি যৌতুকের জন্য স্ত্রী ও তাঁর বাবা-মার প্রতি চাপ সৃষ্টি করেন। তাঁর মতে, অন্যান্য আরও কিছু কারণসহ মূলত যৌতুকের কারণেই এ জেলায় বিয়ে বিচ্ছেদের প্রবণতা বেড়েছে।
এএজেড