কাগজে-কলমে ২৫০ শয্যা অথচ বাস্তবে ১০০ শয্যা হাসপাতাল
উদ্বোধনের চার বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট নওগাঁ সদর জেনারেল হাসপাতালের আধুনিক বহুতল ভবনটি চিকিৎসা সেবার জন্য চালু হলেও তা বাস্তবে ১০০ শয্যা। এতে নানা সমস্যায় কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট কবে চালু হবে সেই বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলতে না পারলেও বারবার চালুর আশ্বাস দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে ৫০ শয্যার এই হাসপাতালটিকে ১০০ শয্যার হাসপাতাল হিসেবে প্রশাসনিক অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর ১৯৯৮ সালে হাসপাতালটিকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করার ঘোষণা দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২০১৩ সালে আটতলা ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তর নওগাঁ কার্যালয়ের কর্মকর্তারা ২০১৮ সালে নতুন ভবনটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে তা হস্তান্তর করেন। কিন্তু ২৫০ শয্যার কার্যক্রম শুরু হয়নি।
বৃহস্পতিবার (২২ ডিসেম্বর) সকাল ১০টার দিকে হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসকদের চেম্বারের সামনে রোগীদের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। রোগীদের চাপে পা ফেলার জায়গাটিও ছিল না কোথাও। হাসপাতালের দুটি টিকিট কাউন্টার থেকে শুরু করে বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ, একতলা ও দোতলার প্রতিটি চিকিৎসকের কক্ষে, ফার্মেসি, প্যাথলজিসহ সব জায়গায় রোগী ও তাদের স্বজনদের ভিড়।
জেলার মান্দা থেকে পায়ের চিকিৎসা করাতে আসেন সালাম মিয়া। তার সঙ্গে আসা মেয়ে সোমা বলেন, ‘অর্থোপেডিক ডাক্তারের কক্ষের সামনে এতই ভিড় যে বাবাকে একপাশে কোথাও বসিয়ে রাখব সেই ব্যবস্থাও নেই। ২ ঘণ্টা অপেক্ষা করে বাবাকে ডাক্তার দেখাতে পারিনি। বাধ্য হয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছি। অন্য কোনো দিন আবার আসবো আর না হয় রাজশাহীতে নিয়ে যাব।’
একই অবস্থা মেডিসিন বিভাগের সামনেও। দীর্ঘ লাইনে প্রায় ৫০-৬০ জনের মতো সেবা প্রত্যাশী দাঁড়িয়ে আছেন। সুফিয়া বেগম নামে এক সেবা প্রত্যাশী বলেন, ‘সেই সকাল ১০টায় এসেছি, এখন ১২টা বেজে গেল। কিন্তু এখনও ডাক্তারের কাছে যেতেই পারলাম না। অনেকে কষ্ট হচ্ছে। আর কিছুক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে আমি আরও অসুস্থ হয়ে পড়ব। একসাথে তিন থেকে চারটি কক্ষে যদি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা রোগী দেখতেন তা হলে এত ভোগান্তি পোহাতে হতো না।’
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা মৌমিতা জলিল বলেন, প্রতিদিন বহির্বিভাগে অন্তত দেড় হাজার রোগী সেবা নিতে আসেন। সকাল ৯টা থেকে ২টা পর্যন্ত একেকজন চিকিৎসক ২০০ থেকে ২৫০ জন রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। এত রোগী দেখার কারণে একজন রোগীকে ৫-৬ মিনিটও সময় দেওয়া যায় না। বহির্বিভাগে রোগী দেখার পাশাপাশি হাসপাতালে ভর্তি রোগীদেরও সেবা দিতে হয়।
নওগাঁর বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য দাবি জানিয়ে আসছে স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁ। সংগঠনটির সভাপতি ডিএম আব্দুল বারী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘চিকিৎসা সেবা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। প্রয়োজনীয় চিকিৎসকের অভাব এবং তাদের দ্বায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে এ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নওগাঁর মানুষ। সামান্য জ্বর, সর্দি হলেও চিকিৎসা নিতে আসা মানুষকে রাজশাহী কিংবা ঢাকায় পাঠানো হয়। তাহলে ২৫০ শয্যার বিশাল ভবন করে লাভ কী?’
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে ভর্তি থাকেন ৩০০ রোগী। গড়ে ১ হাজার ৭০০ রোগী বহির্বিভাগে সেবা নিয়ে থাকেন। এত রোগীকে সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। ১০০ শয্যার জনবল কাঠামো অনুযায়ী সদর হাসপাতালে থাকার কথা ৫৬ জন চিকিৎসকের । কিন্তু সেখানে বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ৩৭ জন চিকিৎসক। বর্তমানে হাসপাতালটিতে কোনো চক্ষু বিশেষজ্ঞ নেই। এছাড়া সিনিয়র কনসালট্যান্ট মেডিসিন ও সিনিয়র কনসালট্যান্ট গাইনি পদ শূন্য রয়েছে। তাছাড়া জুনিয়র কনসালট্যান্ট ও মেডিকেল অফিসারের আরও ১৬টি পদে লোক নেই।
এ ব্যাপারে নওগাঁ সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, তারা চার বছর ধরে হাসপাতালের নতুন ভবন ব্যবহার করছেন। কিন্তু প্রশাসনিক অনুমোদন না পাওয়ায় এখনো ২৫০ শয্যার চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে তারা ২৫০ শয্যার হাসপাতাল চালুর জন্য প্রায় প্রতি মাসে জনবল ও চিকিৎসা সরঞ্জাম চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চাহিদাপত্র পাঠাচ্ছেন। চিঠি চালাচালি চলছে।