৩৫ বছর লাশ টানা হাশেম এখন নিজেই জীবন্ত লাশ!
দীর্ঘ ৩৫ বছর দুই থানা এলাকা থেকে নিজ ভ্যানে মরদেহ নিয়ে মর্গে পৌঁছে দিয়েছেন ষাট বছর বয়সী হাশেম প্রামাণিক। কখনো দুর্ঘটনায় মৃত, কখনো আত্মহত্যা, কখনো হত্যার মরদেহ। আবার কখনো নদী-জঙ্গলে পাওয়া অজ্ঞাত মরদেহও টেনেছেন তিনি। আদালতের নির্দেশে কবর থেকে তোলা দুর্গন্ধযুক্ত মরদেহও টেনেছেন হাশেম।
কখনো মরদেহ ধুয়ে কবরও দিয়েছেন। আবার পুড়িয়েছেন শ্মশ্মানে। ওই দুই থানা এলাকায় মরদেহ বয়ে নিয়ে যেতে হলেই তাকে ফোনে ডেকে নিত পুলিশ।
দীর্ঘদিন মরদেহ টানার কারণে তার নাম হয়ে যায় ‘লাশ টানা হাশেম’। অথচ এখন সেই হাশেমই যেন এক জীবন্ত লাশ। একটি সড়ক দুর্ঘটনার পর থেকে তার জীবন এখন শয্যাগত।
হাশেম নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার কচুয়া কারিগরপাড়া গ্রামের আবু বক্কর প্রামাণিকের ছেলে। তিনি জানান, তিনি ২৫ বছর বয়সে বিয়ে করেন। বিয়ের আগে স্থানীয় বিভিন্ন চা-স্টলে খড়ি সরবরাহ করতেন। বিয়ের পর দাদার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কেনেন একটি ভ্যান। বিয়ের ১৪ দিন পর থেকেই বড়াইগ্রাম আর বাগাতিপাড়া থানা পুলিশের ডাকে মরদেহ বহনের কাজ শুরু করেন।
পারিবারিক জীবনে দুই ছেলে আর তিন মেয়ের বাবা হাশেম। সবাইকেই বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলে শুকুর আর গাফ্ফারও ভ্যান চালান। তাদের সংসার আলাদা। স্ত্রীর এক চোখ অপারেশনের পর অনেক দিন থেকেই তিনি অসুস্থ। এখন মাত্র এক চোখে দেখেন। ওই অবস্থায় তার মরদেহ টানা আয় দিয়ে চলত সংসার।
নিজস্ব সম্পত্তি বলতে তার মাঠে ছিল ১৮ কাঠা আবাদি জমি, আর ৩ কাঠা জমির ওপর বাড়ি। এনিয়েই তবু সন্তুষ্টচিত্তে চলছিল তার জীবন। কিন্তু হঠাৎ এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি এখন নিজেই বোঝা, নিঃস্ব, অসহায়।
হাশেম প্রামাণিক জানান, গত ১৫ জানুয়ারি প্রতিবেশী এক ভাতিজা তার মেয়ের বাড়ি যাওয়ার জন্য হাশেমকে বলেন। নাতনির বাড়ি কাজ সেরে তারা ফিরছিলেন। ওই ভাতিজার নিজেরও ভ্যানগাড়ি থাকায় তিনিই হাশেমের ভ্যান চালাচ্ছিলেন। আর হাশেম গাড়ির ডান দিকে বসেছিলেন। মালঞ্চি বাজার ক্রস করার সময় বিপরীত দিক থেকে ইঞ্জিনচালিত একটি ভ্যান সজোরে তার পায়ে ধাক্কা দেয়। ওই গাড়ির সামনের দুটি রড নাটসহ তার ঠ্যাংয়ের মাংসের ভেতর চলে যায়। আকস্মিক ওই ধাক্কায় ওই ভ্যানটি উল্টে গেলে তার পায়ের হাড় ভেঙে যায়। স্থানীয় লোকজন ওই ঘটনা আর তার রক্তাক্ত অবস্থা দেখে ভয়ে দূরে সরে গেলে তিনি নিজের চামড়ায় ঝুলে থাকা ভাঙা ঠ্যাং নিজ ভ্যানে উঠিয়ে স্থানীয় হাসপাতালে যান। প্রথমে তাকে রাজশাহী, এরপর ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে পর পর দুইবার অপারেশন করতে তার ওই ১৮ কাঠা জমি ও বাড়িতে পালন করা দুইটি বাছুর বিক্রি করতে হয়েছে। এখন তার মাত্র বাড়ির ৩ কাঠা জমি রয়েছে। আগামী ২০ দিন পর তার আরও একটি অপারেশন হওয়ার কথা রয়েছে। অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা, সংসারের খাওয়া খরচের পাশাপাশি ওই অপারেশনের টাকা জোগাড় হবে কীভাবে তা ভেবেই পাচ্ছেন না দিশেহারা হাশেম।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, দুর্ঘটনার পর মাঝে মাঝে তার দুই ছেলে কিছু সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া ওই দুই থানা থেকে সামান্য কিছু টাকা পাঠিয়েছিল। নিজ খরচ জোগাড় করতে কোনো ভ্যানে উঠে সাহায্য চাইতে ভাড়া দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতে চাইলেও ভ্যানচালকরা নেয় না।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাশেম বলেন, ৩৫ বছর লাশ টেনেই জীবন চারিয়েছি, আর এখই নিজেই জীবন্ত লাশ হয়ে জীবনযাপন করছি। অপারেশন ছাড়াও তার প্রতিদিন ৭০০-৮০০ টাকার ওষুধ লাগে। কোনোভাবেই জোগাড় সম্ভব হচ্ছে না।
চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে প্রধানমন্ত্রী, পুলিশ, প্রশাসনসহ সমাজের হৃদয়বান ও বিত্তবানদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন হাশেম।
বড়াইগ্রাম থানার ওসি আবু সিদ্দিক জানান, হাশেম অসুস্থ হওয়ার খবর পেয়ে তাকে তাৎক্ষণিক কিছু সহযোগিতা করা হয়েছে। এখন তার ছেলে শুকুর মরদেহ টানা কাজ করছে। হাশেমের ব্যাপারে তার ছেলের কাছে খবর নেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, হাশেমকে আরও সহযোগিতা করার ব্যাপারে কাজ চলছে।
এসএন