২২ বছরেও আলফ্রেড সরেন হত্যার বিচার হয়নি
প্রয়াত আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলার বিচারকাজ ২২ বছরেও শেষ হয়নি। দীর্ঘ সময়ে হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন না হওয়ায় ন্যায় বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন নিহতের পরিবার ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সদস্যরা।
বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) নওগাঁর আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেনের ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২২ বছর আগে এই দিনে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুরে আলফ্রেডকে হত্যা করে।
দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ায় এ মামলার বিচারকাজ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে পরিবার ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে দেখা দিয়েছে সংশয়। এর উপর অব্যাহত রয়েছে হুমকি-ধমকি। আবার তাদের অনেকেই এরই মধ্যে ভীমপুরের নৃ-গোষ্ঠী পল্লি ছেড়ে চলে গেছেন অন্য জায়গায়।
২০০০ সালের ১৮ আগস্ট ভীমপুর এই পল্লিতে হাতেম-গদাই গংয়ের সন্ত্রাসীদের হামলায় নৃ-গোষ্ঠীর নেতা আলফ্রেড সরেন নৃসংশভাবে খুন হন। ওই ঘটনায় সন্ত্রাসীরা ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়ে নৃ-গোষ্ঠী পল্লির ১১টি পরিবারের বাড়িঘর ভাঙচুর লুটপাটসহ অগ্নিসংযোগ করে। ওই সময় তাদের হামলায় নৃ-গোষ্ঠী নারী-শিশুসহ প্রায় ৩০ জন মারাত্মক আহত হন। ঘটনার সময় নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের সন্ত্রাসীরা পার্শ্ববর্তী পুকুরে নিক্ষেপও করেছিলেন।
এই ঘটনা পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নৃ-গোষ্ঠীর সদস্য, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলসহ সচেতন মহলে ব্যাপক আলোড়ন ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তারা সেই দিন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানায়।
আলফ্রেড সরেন হত্যার পর তার ছোট বোন রেবেকা সরেন বাদী হয়ে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় পুলিশ ৯১ জন আসামির নামে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এর মধ্যে পুলিশ কয়েকজন আসামিকে আটক করে। ওই সময় নওগাঁ দায়রা জজ আদালতে মামলার সাক্ষী গ্রহণ শুরু হয় এবং ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে সেই সময় ১৩ জনের সাক্ষী গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছিল। জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জননিরাপত্তা আইন বাতিল করে। ওই সময় পলাতক শীতেষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ওরফে গদাই (বর্তমানে প্রয়াত) ও হাতেম আলীসহ ৬০ জনের বেশি আসামি জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে মামলাটি হাইকোর্ট ৩ মাসের জন্য স্থগিতাদেশ দেন। এর পর আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আসে।
আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলার বাদী ও আলফ্রেডের ছোট বোন রেবেকা সরেন বলেন, ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট আমার ভাইকে ভূমিদস্যুরা নির্মমভাবে চাইনিজ কুড়াল, রামদা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল হাতেম-গদাই। এই হত্যার পর আমি বাদী হয়ে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করি ও আমার বড় দাদা জননিরাপত্তা আইনে আরেকটি মামলা দায়ের করেন। এই ঘটনার সময় যে পরিবারগুলো বসবাস করতেন তারা মামলার সাক্ষী হওয়ায় তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হতো। জীবনের ভয়ে তারা আজ বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছে।
তিনি আরও বলেন, আমার ভাইকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল একইভাবে ২০১২ সালে আমার ছোট ভাইকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। তারা এখনো আমাদের উপর বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। আজও মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে জমির জন্য আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে সে জমিগুলোও তারা দখল করে খাচ্ছে।
রেবেকা বলেন, আমি চোখের সামনে দেখেছি আমার ভাইকে হত্যার পর আমার মা-বাবা পাগলের মতো হয়ে মারা গেছে। হত্যাকাণ্ডের ২২ বছর অতিক্রম হয়ে গেল আজও আমরা বিচার পাইনি। আর বিচার পাব কি না এইটা নিয়েও আমাদের মধ্যে সংশয় রয়ে গেছে। একটি স্বাধীন দেশে আমরা কখনো এটা ভাবতে পারিনি। যারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানাই।
এ বিষয়ে মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী মহসীন রেজা বলেন, দুটি মামলা একইসঙ্গে তদন্তে করে একটি অভিযোগপত্র দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে মামলাটি নওগাঁ জেলা আদালতে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। আসামিরা জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করলে পরে রিটগুলো খারিজ হয়ে যায়। আলফ্রেড সরেনের হত্যার বিচার কার্যক্রম চলতে থাকলে আসামিরা হাইকোর্টে রিটের খারিজের আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের ডিভিশনে মোকদ্দমা আনে।
তিনি আরও বলেন, আপিল ডিভিশনে সে মোকাদ্দমা শুনানি অন্তে আপিল ডিভিশনের বিচারক পুনরায় সেই রিটগুলো শুনানির জন্য হাইকোর্টে পাঠালে রিটগুলো শুনানির জন্য অপেক্ষামান রয়েছে হাইকোর্টে। আলফ্রেড সরেনের হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম বর্তমানে নওগাঁর দায়রা জজ আদালতে স্থগিত অবস্থায় রয়েছে।
এসএন