নওগাঁয় পানির অভাবে পাট নিয়ে বিপাকে চাষিরা
বর্ষা মৌসুমেও পর্যাপ্ত পানি নেই নওগাঁর বিলগুলোতে। এ অবস্থায় চাষিরা সোনালি আঁশ পাট জাগ দিতে না পেরে জমিতেই ফেলে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকেই কাঁচা পাট পরিবহন করে বিলের নিচু এলাকায় নিয়ে জাগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে পরিবহন ও শ্রমিকবাবদ পাটের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ বলছে, কৃষকদের আগ্রহ বাড়াতে চাষিদের প্রণোদনাসহ সার্বিক সহযাগিতা দেওয়া হচ্ছে। জেলায় এ বছর দেশি, তোষা এবং মস্তা জাতের পাট চাষ হয়েছে। দেশি জাতের মধ্যে রয়েছে সিভিএল-১ ও ডি ১৫৪। তোষা জাতের মধ্যে রয়েছে ও-৪ এবং ৭২।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলায় ৫ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫ হাজার ৭২৫ হেক্টর, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ হাজার ৯৩৩ হেক্টর, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬ হাজার ১৫০ হেক্টর এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছিল। গত ৫ বছরের ব্যবধানে পাটের আবাদ কমেছে ১ হাজার ৬০০ হেক্টর।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, উপজেলা ভিত্তিক পাট চাষ হয়েছে- সদর উপজেলায় ৬০০ হেক্টর, রানীনগরে ৪০ হেক্টর, আত্রাইয়ে ২৫০ হেক্টর, বদলগাছিতে ১ হাজার ৪৬০ হেক্টর, মহাদেবপুরে ২০০ হেক্টর, পত্নীতলায় ১৫০ হেক্টর, ধামইরহাটে ৮৩০ হেক্টর এবং মান্দায় ১ হাজার ৮০০ হেক্টর। জেলার ১১টি উপজেলার মধ্য সাপাহার, পোরশা এবং নিয়ামতপুর উপজেলায় এ বছর কোনো পাট চাষ হয়নি বলে জানায় কৃষি অফিস।
জানা গেছে, এক বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করতে খরচ পড়ে ১০ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে জমির আইল ঠিক করা ৪০০ টাকা, পানি সেচ ১ হাজার টাকা, হালচাষ ১ হাজার টাকা, সার ১২০০ টাকা, বীজ দেড়কজি ৪০০ টাকা, কীটনাশক ও শ্রমিক খরচ ৫০০ টাকা, পোকা দমন কীটনাশক খরচ ৭০০ টাকা। ঘাস নিড়ানিতে ৫-৬ জন শ্রমিকের খরচ ১৫০০-১৮০০ টাকা। এরপর পাট কাটতে ৫-৬ জন শ্রমিকের খরচ হিসাবে ২৫০০-৩০০০ টাকা, পরিবহন খরচ ১৫০০ টাকা এবং জাগ দেওয়া ১৫০০ টাকা। সবশেষ ৬-৭ জন শ্রমিকের পাট পরিষ্কার খরচ পড়ে ৩০০০-৩৫০০ টাকা।
একসময় পাটকে বলা হতো সোনালি আঁশ। তবে পাটের সোনালি ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। পানি সংকটে জাগ দেওয়া সমস্যা, শ্রমিক সংকট ও মজুরি বেশি হওয়ায় এবং দাম না পাওয়ায় পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন চাষিরা। তবু উঁচু জমি ফেলে না রেখে বা অন্য ফসল না হওয়ায় বাধ্য হয়ে চাষিরা পাটের আবাদ করেছেন।
এদিকে পাটের আবাদ কমে যাওয়ায় গত দু’বছর থেকে বেড়েছে পাটের দাম। এক বিঘাতে ৮-১২ মণ পাটের ফলন হয়। প্রতিমণ পাট গত বছর ২৪০০-৩০০০ টাকায় বিক্রি করেছেন বলে জানান চাষিরা।
পলিথিন ব্যবহারের পরিবর্তে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহার বাড়ানো বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন। সচেতনতা বাড়ানো গেলে মানুষ পাটজাত দ্রব্য ব্যবহারের উৎসাহিত হবেন। এতে করে পরিবেশ যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি চাষিরা পাটের আবাদের দিকে ঝুঁকবেন।
নওগাঁ বদলগাছি উপজেলার কোলা ভান্ডারপুর গ্রামের পাটচাষি স্বপন কুমার বলেন, বিগত বছরগুলাতে ৩ বিঘা জমিতে ভালো (দেশি) জাতের পাটের আবাদ করতাম। পানির অভাবে পাট জাগ দেওয়ার সমস্যায় এ বছর ১ বিঘাতে আবাদ করেছি। এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় পাট চাষিদের জন্য বেশি সমস্যায় পড়তে হয়েছে। প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ট্রাক্টর দিয়ে পাট নিয়ে গিয়ে জাগ দিতে হবে। পরিবহন খরচ পড়বে দেড় হাজার টাকা। পাট কাটতে খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা এবং ধোয়ার সময় খরচ হবে আরও ৪ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, পাট চাষে শ্রমিকের মজুরি ও উৎপাদন খরচ বেড়েছে। আবার দাম না পেয়ে লোকসান গুনতে হয়। প্রবাদ আছে, ‘পাটের টাকা পাট (শ্রমিক) খায়’। প্রতি বিঘায় ৮-১৪ মণ পাটের ফলন পাওয়া যায়। আবার পাটকাঠি পাওয়া যায়। দেখা যায় সব মিলিয়ে আয়-ব্যয় সমান হয়। আমাদের শুধু কষ্টই করা হয়। এসব কারণে পাট চাষ আগ্রহ কমেছে।
একই গ্রামের কামাল জোয়াদ্দার বলেন, দেড় বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করেছি। পাটের জমিতে ধান ভাল হয়। পাটের পাতা জমিতে পড়ে উর্বরতা বাড়ে। এতে করে সারের খরচও কম হয়। এ জমিতে বছরে তিনটি ফসল হয়। আগে খিরা চাষ করছিলাম। এরপর পাট লাগিয়েছি। পাট তুলে আমনের ধান রোপন করা হবে। পাটের আবাদ করে লাভ না হলেও লোকসান হয় না। পাট কাঠিও কাজে লাগে। বলা যায় পাটকাঠি লাভ।
মান্দা উপজেলার দক্ষিণ মৈনম গ্রামের ইয়াজ প্রামানিক বলেন, পাটের আবাদ করতে বিঘাপ্রতি প্রায় ৫-৬ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু পাট কাটা, পরিবহন, জাগ দেওয়া ও পাট পরিষ্কার করতে আরও ৬-৭ হাজার টাকা খরচ হয়। গত কয়েক বছর থেকে পাটের দাম পাওয়া যায়নি। কিন্তু গত দুই বছর থেকে সরকার আবারও দাম দিচ্ছে। পাটের রঙের ওপর দাম নির্ভর করে। প্রতি মণ পাট ২৫০০-৩০০০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। পানির অভাব এবার রঙ ভালো হবে না। ব্যবসায়ীরা দাম পেলেও আমরা পাই না। তবে দাম যদি আরেকটু বাড়ানো হয় তাহলে আমাদের জন্য সুবিধা হবে।
মান্দা উপজেলার মোল্লাপাড়া গ্রামের পাটচাষি আব্দুর রহমান বলেন, আগে পাটের দাম পেতাম না। পাট জমিতেই নষ্ট হয়ে গেছে। যা পরে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে দু’বছর ধরে আবারও সরকার পাটের দাম দিচ্ছে। এ বছর ২ বিঘা জমিতে দেশীয় জাতের পাট চাষ করেছি। পাট উঠানোর পর ওই জমিতে আতব ধান লাগানো হবে। তবে পাট জাগ দেওয়া বড় সমস্যা। অনাবৃষ্টিতে নদী-নালা ও ডোবায় পানি নেই।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক এ কে এম মঞ্জুরে মওলা বলেন, চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ৪২৫ হেক্টর কম অর্জিত হয়েছে। পানির অভাবে পাট জাগ দেওয়ায় সমস্যার কারণে কৃষকরা নিরুৎসাহিত হওয়ায় কম পরিমাণ আবাদ হয়েছে। বাজারে বর্তমানে পাটের দাম ভাল হওয়ায় কৃষকরা আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, পাট একটি রপ্তানি পণ্য এবং এর বহু ব্যবহার রয়েছে। বাজারে এত পরিমাণ পলিথিন আছে যা পরিবেশের জন্য বিপর্যয়। পলিথিন ব্যবহারের পরিবর্তে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহার বাড়ানো গেলে পরিবেশ যেমন রক্ষা পাবে তেমনি পাটের হারানো ঐতিহ্য ও গৌরব ফিরে আসবে। পাট চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রণোদনাসহ কৃষি বিভাগ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।
পানির সংকট নিরসনে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পুকুর খনন বা নদী ড্রেজিং (খনন) করে পানি ধরে রাখা যেতে পারে। এতে করে কৃষকরা পাট জাগ দেওয়া সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে পারে।
এসজি/