জৈব সার উৎপাদনে সফল হালিমা, মাসিক আয় অর্ধলাখ
বসত-বাড়ির আঙিনায় টিনের ঘর তুলে ভার্মি কম্পোস্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কেঁচো সার বা জৈব সার উৎপাদন করে খরচ বাদে প্রতি মাসে ৪০-৪৫ হাজার টাকা আয় করছেন টাঙ্গাইলের হালিমা বেগম নামে এক নারী কৃষি উদ্যোক্তা। তার অর্জিত আয় থেকে সংসারের যাবতীয় খরচ মেটানোর পর ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করছেন তিনি।
হালিমা টাঙ্গাইল সদর উপজেলার রাবনা নয়াপাড়া গ্রামের মোয়াজ্জেম হোসেনের স্ত্রী।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, কৃষকের মেয়ে হালিমা বেগম বাল্যবিয়ের শিকার। গ্রামের স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় ২০০৩ সালে হালিমা বেগমের রাবনা নয়াপাড়ার মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়। তাদের ঘরে দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। স্বামীর তেমন আয়-রোজগার না থাকায় তাদের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকত। মেয়ে দুটিকেও স্কুলে দিতে পারেননি। এমতাবস্থায় তিনি গরু লালন-পালন করে দুধ বিক্রির মাধ্যমে মেয়ে দুটিকে স্থানীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন।
এরপর শুরুতে বাড়ির টিনের ঘরে তিনটি গরু দিয়ে ফার্ম তৈরি করে দুধ বিক্রি করে সংসারের খরচের পাশাপাশি মেয়ে দুটিকে লেখাপড়া করাতে থাকেন। পরে গৃহপালিত গরুর গোবরকে কাজে লাগিয়ে জাপানি কেঁচো কিনে কয়েকটি ছোট টিনের ঘর তুলে ভার্মি কম্পোস্ট প্রক্রিয়ায় কেঁচো সার বা জৈব সার উৎপাদন শুরু করেন। ২০০৮ সালে কেঁচো সার উৎপাদনের যাত্রা শুরু করলেও প্রথম দিকে তেমন সুবিধা করতে পারেননি। যে কারণে দুই বছর পর কেঁচো সার বা জৈব সার উৎপাদন বন্ধ করে গরু লালন-পালন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
২০১৫ সাল থেকে আবারও পূর্ণ উদ্যমে কেঁচো সার বা জৈব সার উৎপাদন শুরু করেন। এবার আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কেঁচো সার বা জৈব সার উৎপাদন করে বিক্রি করেন। সাড়াও পান আশানুরূপ। তার তৈরি কেঁচো সার বা জৈব সারের সুনাম আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। জেলা-উপজেলা ছাড়াও বিভাগীয় শহরের বড় বড় দোকানে টনে টনে জৈব সার সরবরাহ করেন তিনি। কেঁচো সার বা জৈব সার উৎপাদন ও বিক্রি করে এখন তিনি সফল উদ্যোক্তা।
শুরুতে জৈব সারের খামারে একা কাজ করলেও এখন তার স্বামী মোয়াজ্জেম হোসেন, ছোট ভাই ও দুইজন মহিলা শ্রমিক নিয়ে সারাদিন কাজ করেন। তার উৎপাদিত কেঁচো সার বা জৈব সারের নাম দিয়েছেন ‘এমএম ভার্মি কম্পোস্ট’। বিভিন্ন উপজেলার কৃষি কর্মকতারা ছাড়াও বিদেশি পর্যটকরা তার তৈরি জৈব সারের খামার দেখতে আসেন এবং পরামর্শ দিয়ে যান। বর্তমানে হালিমা বেগম নিজে কেঁচো সার বা জৈব সার উৎপাদন করছেন এবং অন্যকে উৎসাহিত করছেন।
এ ছাড়া তিনি গৃহিনী, দুস্থ, বিধবা মহিলাদের কেঁচো সার উৎপাদনে উৎসাহিত করে ‘নারী স্বপ্ন উন্নয়ন সংগঠন’ নামে একটি সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেছেন। সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ৫২জন। এর সভাপতি হালিমা বেগম এবং সাধারণ সম্পাদক সাথী আক্তার। প্রতি বৃহস্পতিবার তারা একত্র হয়ে উন্নয়নমূলক আলোচনা সভা করে পরবর্তী করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। হালিমা বেগম কেঁচো সার বা জৈব সারের সফল উৎপাদকের পাশাপাশি সফল কৃষিকর্মীও। তার তৈরি জৈব সার দিয়ে বাড়ির আশপাশে বিভিন্ন রকমের সবজি চাষ করেছেন।
নারী কৃষি উদ্যোক্তা হালিমা বেগত জানান, গৃহপালিত গরু লালন-পালন করে গোবরকে কাজে লাগানোর জন্য আগে দেখে আসা কেঁচো সার উৎপাদনে এগিয়ে আসেন। তার তৈরি জৈব সার রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হয়। ড্রাগন চাষী ও সবজি চাষীরা এই সার ব্যবহার করে থাকেন। শহরের উঁচু ভবনের ছাদে ফল ও ফুলের চাষে জৈব সার ব্যবহার হয়। তিনি শুরুতে হোম ডেলিভারির মাধ্যমে বিক্রি করতেন। পরে পাইকারি বিক্রি শুরু করেন। জৈব সার প্রতি কেচির খুচরা দাম ২৫ টাকা এবং পাইকারি প্রতি কেজি ২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলা কৃষি অফিসার রুমানা আকতার বলেন, কয়েক বছর আগে হালিমা বেগম তার স্বামীকে নিয়ে কৃষি বিষয়ে পরামর্শ নিতে আসেন। সেসময় তাকে কেঁচো বা জৈব সার উৎপাদন প্রকল্প করার পরামর্শ প্রদান করি। এরপর সেই পরামর্শে তিনি সকল বাধা পেরিয়ে কঠোর পরিশ্রম ও দক্ষতায় সফল নারী উদ্যোক্তা হতে পেরেছেন। তার পরিবারটি দরিদ্র ছিল। বর্তমানে তিনি স্বাবলম্বী ও তার প্রকল্পে তিনজন মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। হালিমা যেন আরও ভালো কিছু করতে পারেন সে লক্ষ্যে কৃষি অফিস থেকে বিভিন্ন পরামর্শ ও সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।
আরএ/