নেত্রকোনায় ২০ সিনেমা হলের একটিও নেই
একটা সময় ছিল মানুষের বিনোদনের মাধ্যমই ছিল হলে গিয়ে সিনেমা দেখা। যেকোনো উৎসবের সঙ্গে বাড়তি বিনোদন হিসেবে যোগ হতো সিনেমা। তবে বর্তমানে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার সেই রমরমা অবস্থা আর নেই। দেশের অধিকাংশ স্থানে এখন সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। একই অবস্থা নেত্রকোনা জেলায়ও। এখানকার ২০টি সিনেমা হলের মধ্যে টিকে নেই একটিও।
পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত জেলা শহরের বাসিন্দাদের চিত্তবিনোদনের প্রধান কেন্দ্র ছিল ‘বিজয় টকিজ’ সিনেমা হল (প্রেক্ষাগৃহ)। অজহর রোডে অবস্থিত এ প্রেক্ষাগৃহ পরিচালনা করতেন প্রকৃত মিত্র ও হিরণ মিত্র নামের দুই ব্যবসায়ী। পরবর্তী সময়ে এটির মালিকানায় যুক্ত হন আবদুল হালিম মিয়া নামে আরও একজন। বর্তমানে এসব হলের গল্প আছে বাস্তবে নেই।
১৯৬৩ সালে বিজয় টকিজ হলের মালিকানা হস্তান্তর হয়। তখন ক্রয়সূত্রে প্রেক্ষাগৃহটির মালিক হন নওয়াব আলী মিয়া। ‘বিজয় টকিজ’ এর বদলে তিনি এটির নতুন নাম রাখেন ‘হাসনা টকিজ’।
এ হলের জমজমাট ব্যবসায় খুশি হয়ে নওয়াব আলী মিয়া ১৯৭০ সালে শহরের কোর্ট স্টেশনের পেছনে ‘হীরামন’ নামে আরও একটি প্রেক্ষাগৃহ তৈরি করেন। নওয়াব আলী মিয়ার ছেলে আবদুল কাদির মিয়া এটি পরিচালনা করতেন। ‘হাসনা টকিজ’ ও ‘হীরামন’ হলে সিনেমা দেখেননি নেত্রকোনা শহরে এমন প্রবীণ লোক পাওয়া দুস্কর। অথচ এখন সিনেমা হলের ব্যবসা পুরোপুরি ধ্বসের কাতারে। বন্ধ হয়ে গেছে একের পর সব সিনেমা হল।
নানা বাস্তবতায় জেলার ২০টি সিনেমা হলের মধ্যে সবগুলো এখন বন্ধ। কোনোটির এখন আর অস্তিত্বই নেই। শুধু ‘হীরামন’ হলটি বন্ধ হয়েছে গত বছর। আবদুল কাদির মিয়ার ছেলে শেখ সুলতান তপু পরিচালনা করতেন এ সিনেমা হল। দর্শক কমে যাওয়ায় এটি মালিক বন্ধ করতে বাধ্য হন। অবশিষ্ট নেই একটিও।
প্রেস ক্লাব, নেত্রকোনা জেলা কমিটির সভাপতি শামীম আহমেদ তালুকদার জানান, ‘পাকিস্তান আমলে নেত্রকোনার সিনেমা হলগুলোতে বোম্বের হিন্দি ও পাকিস্তানের উর্দু ছায়াছবির প্রদর্শনী হতো। মাঝে মধ্যে কলকাতা থেকে দু-একটা বাংলা সিনেমা আসত। তখন প্রতিদিন হলগুলোতে তিন-চারটি করে শো চলত। শো চলাকালে তিল ধারণের জায়গা হতো না। লম্বা লাইন ধরে টিকিট কাটতে হতো।’
নেত্রকোনা শহরের পাশাপাশি জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলা সদরেও সিনেমার রমরমা ব্যবসা ছিল। ‘রাজমহল’, ‘দিলশাদ’, ‘মিতালী’ ও ‘কংকন’ নামে একযোগে চারটি সিনেমা হল চালু ছিল সেখানে। সদ্য মুক্তি পাওয়া সিনেমা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা চলত এসব হলে। কালের আবর্তে চারটিই এখন বন্ধ।
‘রাজমহল’ এখন কমিউনিটি সেন্টার। আর ‘দিলশাদ’ গোডাউন। বাকি দুটির অস্তিত্বই নেই। এদিকে পূর্বধলার শ্যামগঞ্জ বাজারেও জমজমাটভাবে চালু ছিল তিনটি সিনেমা হল। হলগুলো হলো- আশা, তরঙ্গ ও হলি। এখন একটিও চালু নেই। একইভাবে বন্ধ হয়ে গেছে কলমাকান্দার বনানী, সমতা, বারহাট্টার মধুমিতা, কেন্দুয়ার সাথী, রামপুরের আনন্দ, দুর্গাপুরের অনামিকা ছবিঘর, সাগরিকা, মদনের লিপি, পূর্বধলার রিয়া। এ ছাড়া চৌরাস্তা ও হুগলা বাজারের আরও দুটি হল এবং আটপাড়ার খেয়া ও মঙ্গলসিদ্ধ এলাকার একটি হলও বন্ধ হয়ে গেছে।
নেত্রকোনা জেলা শহরের ‘হীরামন’ এর পরিচালক শেখ সুলতান তপু জানান, বর্তমান সময়ে সিনেমা হলের ব্যবসা একেবারেই মন্দা চলছে। দর্শকরা এখন আর হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে চায় না। সিডি, ভিসিডি আসার পর থেকেই সিনেমা ব্যবসায় ধস নামতে শুরু করে। আর এখন ইন্টারনেট, ডিস অ্যান্টেনা, মোবাইল ফোনসহ নানা প্রযুক্তির বদৌলতে দর্শকরা ঘরে বসেই সিনেমা দেখতে পারছে। এ ছাড়া একটি সিনেমা মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে পাইরেটেড কপি বের হয়ে যাচ্ছে। এ সবই সিনেমা ব্যবসায় ধস নামার কারণ।
স্থানীয় আবু আব্বাছ ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র শফিকুল ইসলাম জানায়, দুই বছর আগে এ পর্যন্ত মাত্র দুইবার হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছে সে। একটি ‘আয়নাবাজি’। অপরটি ‘মনপুরা’। দুটোই আর্টফিল্ম ধরনের ছায়াছবি। এ রকম ছবি এলে আবার হলে গিয়ে দেখতাম। কিন্তু সুযোগ আর নেই জেলার কোথাও।
অন্যদিকে নেত্রকোনা সরকারি কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী নওরিন আক্তার বলে, ‘হলে গিয়ে কোনোদিনই সিনেমা দেখিনি। দু'বছর আগে একবার একটি ছবি দেখতে কয়েক বান্ধবী মিলে হলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অভিভাবকরা সম্মতি দেননি। তারা জানান, হলে গিয়ে সিনেমা দেখার মতো নাকি পরিবেশ নেই। পরে আমরা সিডি সংগ্রহ করে কম্পিউটারের সাহায্যে বাসায় বসে দেখেছি।’
নওরিনের মতো বর্তমান প্রজন্মের এমন অনেকেই আছে যারা কোনোদিন হলে গিয়ে সিনেমা দেখেনি। অথচ, দু’দশক আগেও সিনেমা ছিল বিনোদনের সেরা মাধ্যম। বিকেল হতেই হলগুলো কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যেত। অনেক সময় কাউন্টারে টিকিট পাওয়া যেত না। কালোবাজারিদের কাছ থেকে বেশি দামে টিকিট কিনতে হতো। আবার অনেকের এক ছায়াছবি বারবার দেখেও যেন তৃপ্তি মিটত না।
উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর জেলা সংসদের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘৯০ এর দশকের পরবর্তীকালে বাংলা চলচিত্রে অশ্লীলতা প্রদর্শনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এক সময় এটা চরম আকার ধারণ করে। অত্যন্ত নিম্নমানের এবং রুচি বিবর্জিত ছায়াছবি তৈরি হতে থাকে। এসব কারণে ভদ্রলোকেরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। বিশেষ করে নারী দর্শকরা সম্পূর্ণভাবে হল বিমুখ হয়ে পড়েন।
তিনি আরও বলেন, এখন মাঝে মাঝে কিছু ভালো ছায়াছবি নির্মিত হয়। কিন্তু হলগুলোর সেই পরিবেশ নেই। সবাই ঘরে বসে দেখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অথচ অতীতে যেকোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে সিনেমা দেখার কর্মসূচি থাকত। বাড়িতে কোনো আত্মীয়-স্বজন বেড়াতে এলেও তাকে নিয়ে সিনেমা দেখানো হতো।’
এসএন