মৃত্যুঝুঁকিতে দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথের যাত্রীরা
বহু পুরোনো যন্ত্রপাতি ও ইঞ্জিন দিয়ে চলছে লঞ্চ
ঢাকা-বরিশাল নৌ পথে বরিশালসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের জীবন ঝুঁকিতে- এমন দাবি করেছেন লঞ্চ যাত্রীসহ সুশীল সমাজ। লঞ্চে যাত্রীদের ধারন ক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রী বহন করা এই ঝুঁকির প্রধান কারণ। এছাড়া নেই আধুনিক অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র। এছাড়া মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি এবং ইঞ্জিন দিয়েই চলাচল করছে লঞ্চগুলো।
লঞ্চে লাইফ বয়া, ফায়ার বাকেট, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র, হস্তচালিত পাম্প, বালির বাক্স, রেডিও, সেফটি টর্চ, কম্পাস, ফাস্ট এইড বাক্স, জিপিএস, ইকো সাউন্ডার, জীবন রক্ষার সরঞ্জামাদি কিছুই আধুনিক নয়। এদিকে প্রায়ই নতুন লঞ্চ দক্ষিণাঞ্চলের নৌ রুটে নামছে। এ লঞ্চগুলোতে অধুনিক ডেকোরেশন থাকলেও সেখানে নেই আধুনিক জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জমাদি।
ঝালকাঠি লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় টনক নড়েছে পুরো দেশের। এক এক করে এ পর্যন্ত ৪২ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। নিখোঁজ রয়েছেন আরও অর্ধশত যাত্রী। এছাড়া ঝালকাঠি সদর হাসপাতাল, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে এখনও অনেক রোগী ভর্তি। তারা অনেকে সুস্থের পথে বলে জানিয়েছেন দ্বায়িত্বরত চিকিৎসকরা।
বরিশাল লঞ্চ টার্মিনালে বিভিন্ন লঞ্চে সরেজমিনে দেখা যায়, বিলাসবহুল লঞ্চের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তলায় যাতায়তের জন্য লিফট, কেভিন গুলোতে এয়ারকন্ডিশন, টেলিভিশন, ওয়াইফাই ব্যবস্থাসহ লঞ্চে রয়েছে ভিআইপি মানের খাবার ক্যান্টিন। কিন্তু লঞ্চে যাত্রীদের জীবন রক্ষার জন্য তেমন কোনো আধুনিক অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জাম চোখে পড়েনি একটি লঞ্চেও। দেখা যায়নি লঞ্চের কেবিনের যাত্রীর সংখ্যা অনুযায়ী লাইফ বয়া।
লঞ্চের যাত্রী শিক্ষার্থী রাজু আহমেদ বলেন, ‘লঞ্চে মানুষের দৃষ্ঠি আকর্ষণ করার জন্য নানা আলোকসজ্জা করা হয়েছে। যে যত বেশি পারে তত ডেকোরেশন করে। কিন্তু যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা রাখেনি। আসলে সকলে ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত তাদের মানুষ নিয়ে ভাবার সময় তাদের নেই। এই যে লঞ্চ দুর্ঘটনা হয়েছে মানুষ মারা গেছে, দুই অথবা তিন মাস পরে সব কিছু ভুলে যাবে। আর আমাদের বছরের পর বছর অবহেলায় অপমৃত্যু হবে।’
ঢাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত লঞ্চ যাত্রী নাসির উদ্দিন বেল্লাল বলেন, ‘এমন মৃত্যু আমাদের কাম্য নয়, আমরা ঢাকা-বরিশাল নৌ রুটের প্রত্যেক লঞ্চে যাত্রীদের জন্য নিরাপত্তা চাই। এই কুয়াকাটা-২ লঞ্চে লাইফ বয়া আছে মাত্র ১৭০টি কিন্তু এই লঞ্চে যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৭৫০/৯০০ জন মানুষ অথচ যাত্রী বহন করে হাজারেরও বেশি এবং লঞ্চের আধুনিকায়ন অনুযায়ী নিরাপত্তার কোন বালাই নেই। কোন দুর্ঘটনা ঘটলে বাকি মানুষ গুলো কি পানিতে ডুবে মরবে? এই প্রশ্ন কার কাছে করবো?’
কুয়াকাটা-২ লঞ্চের ম্যানেজার নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের লঞ্চে যাত্রীদের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে। কুয়াকাটা-২ লঞ্চটি দুই তলা। এছাড়া অগ্নি নির্বাপনের জন্যও আমাদের স্টাফদের ট্রেনিং দেওয়া আছে। সরকার নির্ধারিত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আমরা সব ব্যবস্থা রেখেছি।’
বরিশালের সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, ‘বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের লাখো মানুষ এই নৌ পথের লঞ্চে চলাচল করে। ইতোমধ্যে দেশবাসী দেখেছে এবং জেনেছে যে প্রত্যেক লঞ্চে আধুনিক ডেকারেশন থাকলেও নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আমরা জোর দাবি জানাই লঞ্চে চলাচলকৃত যাত্রীদের শতভাগ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। লঞ্চ কর্তৃপক্ষকে সচেতন হতে হবে ও লঞ্চ তৈরি শুরু থেকে আধুনিক অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা মাথায় রাখতে হবে এবং সেটি বাস্তাবায়ন করতে হবে। প্রশাসনকে অতি দ্রুত সব লঞ্চ যাচাই-বাছাই করে নিরাপত্তা যেখানে যা প্রয়োজন সেই ব্যবস্থা করতে হবে।’
একাধিক লঞ্চ মালিকপক্ষ ঢাকাপ্রকাশকে জানিয়েছে, তারা কখনও সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে যায় না। লঞ্চের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী যাত্রী ওঠেন। অধিক যাত্রী নিতে গিলে তাদের লঞ্চের ক্ষতি হয়। তারা বলেন, ‘আমাদের নিজেদের ক্ষতি করে অন্যের উপকার কখনই করবো না। বর্তমানে করোনা মহামারী চলছে সে ক্ষেত্রে সরকারি সিদ্ধান্তে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই লঞ্চ পরিচালনা করি। ঝালকাঠিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আমরা সতর্ক হয়েছি। আমাদের সকল স্টাফকে সতর্ক করে দিয়েছি এখন থেকে যাত্রীদের দিকে এবং লঞ্চের প্রতি আরো বেশি যত্নশীল হতে হবে। লঞ্চে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রসহ যেখানে যা প্রয়োজন আমরা আরও আধুনিক করার চিন্তা-ভাবনা ইতোমধ্যে মাথায় নিয়েছি।
বরিশাল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক বেলাল উদ্দিন বলেন, ‘সকল লঞ্চের স্টাফদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এই প্রশিক্ষণ যেন দ্রুত দেওয়ার ব্যবস্থা করে সেই অনুরোধ করছি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। আমরা সব সময় চেষ্টা করছি সকলেই যেন নিরাপদ থাকে সে বিষয়ে সচেতন করতে।’
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) যুগ্ম-পরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘লঞ্চগুলো অতিরিক্ত যাত্রীবহন করলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেবো। আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবো। এছাড়া আমাদের সার্ভেতে প্রত্যেক লঞ্চে যতগুলো লাইফ বয়া থাকার কথা বা অন্য জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম থাকার কথা তা আছে কি-না সেটি আমার দেখবো।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক বলেন, ‘সকল জাহাজে অগ্নি নির্বাপণ সরঞ্জামাদি এবং শ্রমিকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ থাকা বাধ্যতামূলক। ইতোপূর্বে লঞ্চ কর্তৃপক্ষকে যাত্রীদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। কেউ নিয়মের ব্যত্যয় করলে তাদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, ঝলকাঠিতে গত বৃহস্পতিবার রাতে লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত ৪২ জনের মৃত্যু এবং শতাধিক যাত্রী দগ্ধ হয়েছে। এর আগে গত ১২ নভেম্বর ঝালকাঠিতে তেলের জাহাজে বিস্ফোরণে ছয়জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ২০১৯ সালে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীতে তেলের জাহাজে বিস্ফোরণে একজন নিহত এবং পাঁচজন শ্রমিক দগ্ধ হয়।
এসও/এএন