ভাতাভোগী মুক্তিযোদ্ধার নাম ৫০ বছরেও গেজেটভুক্ত হয়নি
মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাহত মানুষের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন সুলতান। যার পুরো নাম সুলতান উদ্দিন তালুকদার। মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনে যুদ্ধসারথী ছিলেন তিনি। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিববাড়ি যুব অর্ভ্যথনা ক্যাম্পে তিনি ছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবক। সেজন্য ভাতাও পেয়েছিলেন তিনি। সেই ভাতাভোগী মুক্তিযোদ্ধার নাম আজও গেজেটভুক্ত হয়নি।
যুদ্ধকালীন সময়ের বর্ণনা দিয়ে সুলতানের স্ত্রী আছিয়া সুলতানা বলেন, ‘তিন শিশু সন্তানের দুজনকে কোলে করে বাড়ি বাড়ি গিয়েছি। কেউ একদিন থাকতে দিলে পরের দিন না করে দিয়েছে। স্বামী মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে জানার পর কেউ আশ্রয় দিতে চায়নি। বাড়ি-ঘরে থাকতে পারিনি। স্বামী ফিরে আসবে কি-না তাও অজানা ছিল।’
তিনি বলেন, ‘ নিজের নামটি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় দেখে যেতে পারেনি আমার স্বামী, আমি কি দেখে যেতে পারবো?’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বামী চলে গেছে, আমিও চলে যাবো। অন্তত স্বামীর প্রাপ্য অধিকারটুকু নিয়ে মরতে চাই, মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গেজেটভুক্ত হবে স্বামীর নাম, এটি কারও দয়া বা করুণা নয়, এটি হলো আমার স্বামীর কাজের স্বীকৃতি। এ স্বীকৃতি না পেলে পহেলা মার্চ থেকে আমিও আন্দোলনে নামবো। স্বামী সেবা করতো, আমি আমরণ অনশন করবো। ওকে গিয়ে বলতে পারবো, তোমার স্বীকৃতির জন্য আমিও লড়াই করে এসেছি। এ কথাগুলো বলতে গিয়ে বারবার আঁচলে মুখ মুছেন আছিয়া সুলতানা।
সুলতান উদ্দিন তালুকদার মৃত্যুর সময় পাননি রাষ্ট্রীয় মর্যাদাও। ২০০৪ সালের ৯মে চিরবিদায় নেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮সালের ৩১জানুয়ারি। যুদ্ধের সময় লেখাপড়া ছেড়ে চলে যান মুক্তিযুদ্ধে। পরে ১৯৭২ সালে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্টিক পাস করেন। তার রোল নাম্বার গৌরী পি ৪৭১।
যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বাঁচাতে সুলতান উদ্দিন তালুকদার ছিলেন সদাপ্রস্তত। ক্যাম্পে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট পরিচিত এক নাম ছিল সুলতান। এ ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনের জন্য মুজিবনগর সরকারের একজন ভাতা ভোগীও ছিলেন তিনি। সর্বশেষ ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর তারিখে ৭৫ টাকা সর্বশেষ ভাতাও উত্তোলন করেন তিনি। ভাতাভোগীর ১১ জনের মধ্যে তার ক্রমিক নং ৯। এ তালিকার ১০ জনই মুক্তিযোদ্ধা। শুধু গেজেটভুক্ত হয়নি সুলতান উদ্দিন তালুকাদারের নাম! এছাড়া আরও একটি মুক্তিযোদ্ধা তালিকা (অন্তর্ভুক্তি) ৪০ জনের যে তালিকা প্রস্তুত হয় সেখানে সুলতান উদ্দিন তালুকদারের নাম ১৫ নং ক্রমিকে। এ তালিকার অনেকেই গেজেটভুক্ত হয়েছেন। হয়নি সুলতান উদ্দিন তালুকদারের নাম।
তার বড় ছেলে মহি উদ্দিন তালুকদার লিটন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ করেছে আমার বাবা বিজয়ের ৫০ বছরেও তালিকাভুক্তি না হওয়ায় দুঃখজনক।’
অপর পুত্র কামরুজ জামান স্বপন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় মায়ের পেটে এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি দৌড়েছি আশ্রয়ের জন্য আর আজ স্বীকৃতির জন্য এ দপ্তর থেকে ও দপ্তরে যাচ্ছি, আসলে যুদ্ধটা শেষ হলো কোথায়!’
স্বামীর মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির জন্য ২০০৬ সালে প্রথম আবেদন করেন আছিয়া সুলতানা। এরপর থেকে বারবার এ দপ্তর, ওই মন্ত্রণালয় ঘুরতে ঘুরতে আজ ক্লান্ত। সাক্ষাৎকার ও যাচাই বাছাইয়ের আসরে যেতে যেতে হাঁপিয়ে উঠেছেন। আছিয়া সুলতানের বয়সও ৭০র কোটা ছাড়িয়েছে। শরীরে বাসা বেঁধেছে বার্ধ্যকজনিত নানা রোগ। এই আছেন ভালো, এইতো খারাপ এমন শংকায় কাটছে দিন।
তার দুই মেয়ে আম্বিয়া আক্তার ও রোকেয়া আক্তার বলেন, ‘আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা। তা না হলে সরকার বলুক তিনি যুদ্ধ করেননি, ভারতে প্রশিক্ষণ নেননি।’
অপরদিকে ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারিতে ভারতের শিববাড়ি ইয়ুথ ক্যাম্পের ইনচার্জ ডা. এম.এ. সোবহান প্রত্যয়নে লিখেছেন, ‘মো. সুলতান উদ্দিন তালুকদার ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিববাড়ী যুব শিবিরে ১৯৭১ সালের মে মাসে যোগ দেন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন এই ক্যাম্পে। শিবিরে দীর্ঘকাল অবস্থানকালীন সময়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাধিক মূল্য দিয়ে যুদ্ধাহতদের নিরলসভাবে সেবা দেন।’
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এমসিএ হাতেম আলী মিয়া তার দেওয়া প্রত্যয়নপত্রে লিখেন, ‘শিবিরে সুলতান মিয়া দীর্ঘ অবস্থানকালে দেশের মুক্তির উদ্দেশ্যে কাজ করেন। তার মনোযোগ ছিল সবসময় সেবা দেয়া। সুলতান উদ্দিন তালুকদার মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিমাসে ৭৫ রুপী সম্মানী ভাতা পেতেন।’ তিনি এ প্রত্যয়ন প্রদান করেন ১৯৭৭সালের ৭ ফেব্রুয়ারিতে।
স্বামীর নামটি গেজেটভুক্ত করতে সর্বশেষ ২০১৪ সালের ২২ মে অনলাইনে আবেদন করেন আছিয়া সুলতানা। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ২৭ জুন যাচাই-বাছাই হয়। সেই যাছাই-বাচাই কমিটিতে ছিলেন সাত জন সদস্য। তারা হলেন সভাপতি ১৪৮ ময়মনসিংহ-৩ গৌরীপুর আসনে এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন আহমেদ, সদস্য সচিব উপজেলা নির্বাহী অফিসার মর্জিনা খাতুন, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ময়মনসিংহ জেলা কমান্ডারের প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম মুহাম্মদ আজাদ, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুর রহিম, কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন, জামুকার প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কদ্দুছ।
এ কমিটি মুক্তিযোদ্ধার প্রামাণ্য দলিলের ভিত্তিতে ৬ জনকে তালিকাভুক্ত করার জন্য সুপারিশ করেন। এ তালিকার ১ নং ক্রমিকে ছিল সুলতান উদ্দিন তালুকাদারের নাম। অথচ অন্যদের হলেও বাদ পড়েছেন শুধু তিনি। মুক্তিযোদ্ধার নতুন গেজেট সংক্রান্ত ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রকাশিত তালিকা দেখে ভেঙে পড়েন আছিয়া সুলতানা। তিনি বলেন, ‘এবার শুধু আমি নই, আমার পুরো পরিবার হতাশ। আমার স্বামী যুদ্ধে গিয়েছিল, তালিকায় নাম তুলতে নয়, যুদ্ধ করতে। আমরা শুধু তার প্রাপ্য অধিকারটুকু দেখে যেতে চাই।’
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কদ্দুছ ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘যে তালিকার ৫ জন হলো সেই তালিকার এক নম্বর ক্রমিকের নাম বাদ পড়ে কিভাবে? মুক্তিযুদ্ধ করার পরেও তালিকায় নাম উঠানোর জন্য আরেকটা যুদ্ধ করতে হবে এটা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং লজ্জাজনকও।’
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুর রহিম ঢাকাপ্রকাশকে জানান, যাছাই-বাচাই কমিটি কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে তার স্বীকৃতির জন্য জোর সুপারিশ করা হয়েছে। বিষয়টি আপিল বিভাগে রয়েছে।
একে/এএন