৫০ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি তারাকান্ত ভৌমিক
ইনসেটে শহীদ ডা. তারাকান্ত ভৌমিক
মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি পাকবাহিনীর হাতে নিহত ডা. তারাকান্ত ভৌমিক। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর গুলিতে আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন।
১৯৭১-এ বাংলা ২০ শ্রাবণ মঙ্গলবার পাক সেনারা তাকে নিজ বাড়ি ভিতরবন্দ থেকে ধরে নিয়ে যায়। সে সময় পাকবাহিনী লুটপাট করে তার ঘর-বাড়ি। পরদিন ঈদগাহ মাঠের পাশে ডা. তারাকান্তসহ মোট ৩৬ জনকে পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন আতাউল্লাহ খানের নির্দেশে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। পরে সেখানে তাদের মাটিচাপা দেওয়া হয়। আজও সে স্মৃতি ভুলতে পারেনি স্বজনরা।
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ এলাকার ডা. তারাকান্ত ভৌমিকের বাড়িতে গেলে তার ছেলে প্রভাত ভৌমিক জানান, তার বাবা তারাকান্ত ভৌমিক ১৯২৫ সালে বাড়ির পাশে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা (এস.এস.সি) পাশ করে ময়মনসিংহ লিটন মেডিকেল স্কুলে কম্পাউন্ডারি পড়েন। তারপর ভিতরবন্দ পরগনার জমিদার জীতেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরী ও ধীরেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত উমেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য দাতব্য চিকিৎসালয়ের কম্পাউন্ডার হিসেবে চাকুরি নিয়ে নাগেশ্বরীর ভিতরবন্দে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। এক সময় দাতব্য চিকিৎসালয় বন্ধ হয়ে গেলেও তিনি আর ফিরে যাননি জন্মস্থান ঘাটাইলে।
সময় গড়িয়ে ৭১ আসে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। প্রাণভয়ে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালাতে থাকে মানুষ। এ সময় ডা. তারাকান্ত ভৌমিক তার স্ত্রী, ৩ মেয়ে ও ৪ ছেলেকে নিরাপদে ভারতে পাঠিয়ে দিয়ে দেশ, মাটির টানে থেকে যান বাড়িতে। এ সময় তিনি আহত, অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছেন চিকিৎসা সেবা। ভেবেছেন, তিনি তো সেবক। চারপাশে যারা বসবাস করেন, তারা সবাই তার আপন। কোন বিপদ এলে তারাই সামলাবেন। এই অপরিসীম বিশ্বাসই কাল হয়েছে তার জীবনে। এক সময় তার নাম কানে যায় রাজাকারদের।
চিরচেনা কিছু মানুষ, যারা রাজাকারে নাম লিখিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছিল তারাই তাকে ধরিয়ে দিয়েছে পাকবাহিনীর হাতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলা ২০ শ্রাবণ পাক সেনারা তাকে ভিতরবন্দের নিজ বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। সেদিন ভিতরবন্দ থেকে তার শ্যালক সুকেশ চন্দ্র ঘোষ ও অজ্ঞাত আরও ১ জনকে তারা ধরে নিয়ে যায়। সেদিন থানায় রেখে পরদিন তাকেসহ মোট ৩৬ জনকে কেন্দ্রী ঈদগাহ মাঠের পাশে গুলি করে হত্যা করে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সেদিনের ১২ বছরের যুবক পৌরসভার বদিজামাপুর কানিপাড়া গ্রামের শাহজাহান আলী এখন ষাটোর্ধ বৃদ্ধ। তিনি জানান, সেদিন পাকবাহিনীর সদস্যরা তাকেসহ আরও ৮-১০ জনকে দিয়ে সেখানে দুটি গর্ত করে নিহতের মরদেহ মাটিচাপা দেয়। সেদিনের কথা মনে হলে আজও তার গা শিউরে ওঠে। পরবর্তীতে সেখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হলেও আজও শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পায়নি তারাকান্ত ভৌমিক।
প্রভাত ভৌমিক বলেন, ‘দেশের প্রতি অগাধ ভালবাসা থাকায় আমার বাবা জীবনের মায়া ত্যাগ না করে দেশে থেকে অতি সঙ্গোপনে আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়ে গেছেন। এ কারণে পাক বাহিনীর হাতে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। তারপরেও স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও তাকে দেওয়া হয়নি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিস্ট দপ্তরে অনেকবার ঘুরেও কোনো সুফল পাইনি। আমার আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। মৃত্যুর পুর্বে শুধু এটুকু জেনে যেতে চাই আমি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ উদ্যোগ শেকড় সহকারী অধ্যাপক সভাপতি মনোয়ার হোসেন সিদ্দিকী বলেন, ‘৭১ এ সেদিন নাগেশ্বরীতে পাক বাহিনীর হাতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছিলেন তিনি। স্বীকৃতিস্বরূপ তার নাম শহীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন।’
এ প্রসঙ্গে নাগেশ্বরী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মো. মতিয়ার রহমান নান্টু জানান, পাকিস্তানি বাহিনী ডা. তারাকান্তকে তার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি। এটি সত্যিই আমাদের জন্য দুঃখজনক।’
/এএন