কুড়িগ্রামে জেঁকে বসেছে শীত, বাড়ছে খেজুর রসের চাহিদা
উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামে শীত জেঁকে বসেছে। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা বেড়েছে খেজুরের রসের। ভোর হতেই তরুণ, যুবক, শিশুরা ছুটছে গাছিদের কাছে মিষ্টি খেজুরের রস খাওয়ার জন্য।
সদর পৌসভার বাসিন্দা ফাসেমা বেগম বলেন, ‘খেজুর রস আর রসের তৈরি পিঠা উৎসব চলবে শীত জুড়ে। খেজুরের রস দিয়ে ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা, পাটিশাপ্টা, রস পিঠাসহ বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরি হয়। তবে বর্তমানে আধুনিক যুগে এই ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে।’
পরিবেশ বান্ধব এই খেজুর গাছ সরকারি-বেসরকারি ভাবে রোপন করে দারিদ্রপীড়িত কুড়িগ্রাম জেলার ভাঙ্গন এবং অর্থনৈতিক ভাবে এগিয়ে নিতে বিশেষ ভূমিকা রাখাবে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
খেজুর গাছ মধুবৃক্ষ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত একটি গাছ। শীত মৌসুমে বাংলাদেশের গ্রাম বাংলায় খেজুর রসের চাহিদা ব্যাপক। শহরেও বেশ কদর রয়েছে। বছরে একবার শীতকালে এই রস আহরণ করা হয়।
আব্দুল কুদ্দুস এবং রমজিত রাজশাহীর বাঘা উপজেলার গড়গড়িয়া ইউনিয়নের বামনডাঙ্গা ও চন্ডিপুর ইউনিয়নের চন্ডিপুর গ্রামের বাসিন্দা। তারা অক্টোবর থেকে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের পাঁচপীর বাজার সংলগ্ন টুপামারী পুকুর পাড়ে অবস্থান করছেন। সেখানে প্রায় দুই শতাধিক খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে খেজুর গুড় তৈরিতে ব্যস্ত তারা। সেখানে উপচে পড়া ভীড় সাধারণ মানুষের। কেউ খেজুরের রস খেতে আবার কেউ নির্ভেজাল খেজুর গুড় কিনতে এসেছেন।
অপর গাছি রাজশাহীর বাঘা পৌরসভার বাসিন্দা বিসসাত আলী এবং আলম মিয়া সদর উপজেলার বেলগাছা ইউনিয়নের কালিরহাট বাজার সংলগ্ন এলাকায় কাজ করছেন। এখানে রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধ প্রায় শতাধিক খেজুর গাছ ভাড়া নিয়ে রস সংগ্রহ এবং গুড় তৈরি করছেন তারা।
গাছি আব্দুল কুদ্দুস বলেন, কুড়িগ্রামে এসেছি প্রায় দুই মাস হতে চলল। প্রতিটি খেজুর গাছ ১৫০টাকা করে ভাড়া নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রায় এক মণ করে খেজুর রস পাওয়া যায়। এখান থেকে প্রতিদিন গুড় হয় ১৫/২০কেজি করে। প্রতি কেজি গুড় ১৬০/১৭০ টাকা দরে বিক্রি হয়। মানুষ এবং ব্যবসায়ীরা এখান থেকে এসে নিয়ে যায়। আর খেজুর রস ৪০টাকা করে কেজি বিক্রি করি।
গাছি নুর আলম জানান, আমরা ৮০টি গাছ থেকে রস নামাচ্ছি। প্রতিদিন ভোর ৫/৬টায় রস নামিয়ে গুড় তৈরি করতে হয়। প্রতি কেজি গুড় ১৮০ টাকা এবং খেজুর রস ৪০টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এই খেজুর রস সংগ্রহ করা যাবে মাঘ মাস পর্যন্ত। তিনি আরও বলেন, কুড়িগ্রামে খেজুর গাছের সংকট। হাতে গোনা কিছু জায়গায় খেজুর গাছ পাওয়া যায়।
গাছি রহমত আলী জানান, রস আহরণের জন্য প্রথমে হাতে দা ও কোমরে দড়ি বেঁধে খেজুর গাছে উঠে নিপুণ হাতে গাছ চাছা-ছেলা করতে হয়। পরে ছেলা স্থানে বাঁশের কঞ্চি বা স্টিলের পাত বসানো হয়। সেই নল বেয়ে নেমে আসে সুস্বাদু খেজুর রস। কাক ডাকা ভোর থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে হয়। এরপর ৯/১০টা পর্যন্ত রস জাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। কেউ আবার গুড় থেকে পাটাালি তৈরি করে বিক্রির জন্য। আবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত রস সংগ্রহের জন্য গাছে গাছে কলস এবং বোতল বাঁধা হয়।
ক্রেতা নাজমুল বলেন, আমাদের এখানে গাছিরা এসে খেজুর রস সংগ্রহ করেন। সেখান থেকে ভেজালমুক্ত খেজুর গুড় আমরা কিনতে পারি। আমাদের এ অঞ্চলে খেজুর গাছের সংখ্যা কম। সরকারিভাবে খেজুর গাছ রাস্তার দুপাশে লাগানো হলে এলাকার মানুষ খেজুর গুড় তৈরি করে নিজেদের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি গুড় রপ্তানি করে বাড়তি আয় করতে পারবে।
খেজুর গাছে প্রাকৃতিক উপকারি বৃক্ষ হিসেবে উল্লেখ করে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর মির্জা নাসির উদ্দিন জানান, তাল গাছ বজ্রপাত নিরোধ করে, খেজুর গাছ দিয়েও এটি সম্ভব। খেজুর গাছ মাটির ক্ষয় রোধ করে। আমাদের কুড়িগ্রাম বন্যা প্রবণ এলাকা হওয়ায় সরকারি-বেসরকারিভাবে খেজুর গাছ রোপন বৃদ্ধি করা গেলে জেলার ভাঙন ও মাটির ক্ষয় রোধ কমিয়ে আনা সম্ভব। খেজুর গুড় তৈরি করে রপ্তানি করে জেলার অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বাড়ানো যাবে।
এ প্রসঙ্গে কুড়িগ্রাম জেলার কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘খেজুরের রস প্রাকৃতিক নিয়মেই হয়ে থাকে। বর্তমানে নিপা ভাইরাসসহ বিভিন্ন ভাইরাসের কারণে আমরা খেজুর রস সংগ্রহ করতে গাছিদের নেট ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আর জেলায় উুঁচ স্থান তুলনামূলক কম হওয়ায় খেজুর গাছ লাগানো প্রবণতা কম। এরপরেও আমরা কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি।’
/এএন