ক্লাস না করিয়ে বেতন-ভাতা তুলছেন মেয়রের স্ত্রী
জামালপুরের ইসলামপুর পৌরসভার গাঁওকুড়া জবেদা খাতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নাছিমা খাতুন। কিন্তু তাকে কখনো ক্লাস নিতে দেখেনি শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি মেয়রের স্ত্রী হিসেবেই পরিচিত। মাঝেমধ্যে বিদ্যালয়ে ঘুরতে আসেন তিনি। অথচ বিদ্যালয়ে ক্লাস না করিয়ে মাসের পর মাস বেতন-ভাতা তুলছেন এই শিক্ষক । বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’ হলেও মেয়রের স্ত্রী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পান না কেউ। এ জন্য এই বিষয়টি জেনেও কখনো ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জানা গেছে, নাছিমা খাতুন ইসলামপুর পৌরসভার মেয়র মো. আবদুল কাদের সেখের স্ত্রী। আবদুল কাদের উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ২০১১ সাল থেকে টানা তৃতীয়বারের মতো মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
শিক্ষক নাছিমা খাতুনের ব্যাপারে জানতে চাইলে ওই বিদ্যালয়ের চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠা দুইজন শিক্ষার্থী আরও জানায়, নাছিমা নামের কোনো শিক্ষককে তারা চেনে না। তবে মেয়রের স্ত্রী পরিচয় দিলে ঠিকই চিনতে পারে। তখন একজন বলে, ‘মেয়রের স্ত্রী মাঝেমধ্যে বিদ্যালয়ে আসতেন। কিন্তু কখনো আমাদের ক্লাস করাতে দেখি নাই। তিনি যে শিক্ষক, সেটা জানতাম না।’ কয়েকজন অভিভাবকও একই ধরনের মন্তব্য করেন।
দীর্ঘদিন ধরে ওই শিক্ষক বিদ্যালয়ে যান না- এ বিষয়টি জানতেন না বলে জানালেন জেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. হারুন-অর-রশিদ। তিনি বলেন, এই প্রথম শুনলেন তার পরিবর্তে অন্য কেউ ক্লাস নেন। বিষয়টি সত্য হলে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া ওই শিক্ষকের ছুটির কোনো আবেদনও তাদের কাছে নেই।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, বিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শ্রেণিকক্ষ তালাবদ্ধ। শুধু কার্যালয়ের কক্ষটি খোলা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিক্ষার্থী ভর্তির কাজে ব্যস্ত। অন্য শিক্ষকরা থাকলেও শিক্ষক নাছিমাকে পাওয়া গেল না। তার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেও কেউ ভয়ে তথ্য দিচ্ছিলেন না।
এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আকলিমা খাতুন বলেন, ‘সম্প্রতি উপজেলা শিক্ষা কার্যালয় থেকে বিদ্যালয়ে না আসা শিক্ষকদের নাম জানতে চেয়েছিল। আমি তথ্য দিয়েছি। বাকিটা শিক্ষা কার্যালয় বুঝবে।’
তিনি আরও বলেন, নাছিমা খাতুনের পরিবর্তে মর্জিনা আক্তার নামের একজন ক্লাস নেন। ওই দিন বিদ্যালয়ে ছিলেন না মর্জিনা।
তার বাড়িতে গেলে মর্জিনা বলেন, ‘২০১৯ সাল থেকে নাছিমার পরিবর্তে আমি বিদ্যালয়ে ক্লাস নেই। পারিশ্রমিক হিসেবে নাছিমা প্রতি মাসে আমাকে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা করে দেন। হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতে তিনি মাঝেমধ্যে বিদ্যালয়ে যান।’
এদিকে খবর পেয়ে বিদ্যালয়ে ছুটে আসেন নাছিমা খাতুন। তিনি বলেন, ‘কে বলছে, আমি আসি না। আমি বিদ্যালয়ে আসি। মাঝেমধ্যে যখন অসুস্থ থাকি তখন মর্জিনা আমার পরিবর্তে ক্লাস নেন।’ তবে অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যান তিনি।
নাছিমা ওই দিনের পর বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন কি না জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক আকলিমা খাতুন বলেন, ‘নাছিমা এখনো বিদ্যালয়ে আসেন না। আপনি (প্রতিবেদক) যেদিন আসছিলেন, সেদিনই আসছিলেন। এরপর আর আসেননি।’
এ ব্যাপারে পৌর মেয়র আবদুল কাদের বলেন, তার স্ত্রী অনেক অসুস্থ। তার অসুস্থতার বিষয়টি শিক্ষা কর্মকর্তারা জানেন। অসুস্থতার কারণে মাঝেমধ্যে তার স্ত্রী বিদ্যালয়ে যেতে পারেন না। সেই দিনগুলোতে মর্জিনা ক্লাস নেন।’
বিদ্যালয়ে না গিয়ে বেতন-ভাতা তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি খুব সৎভাবে চলি। আমার আয়ের বেশির ভাগ গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেই। আমার স্ত্রীর বেতন সন্তানদের লেখাপড়ায় খরচ হয়।’
উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত গাঁওকুড়া জবেদা খাতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ২০১৩ সালে সরকারিকরণ হয়। ১৯৯১ সাল থেকে নাছিমা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। ২৪০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে বিদ্যালয়ে নাছিমাসহ আছেন পাঁচজন শিক্ষক।
এসআইএইচ