ঝিনাইদহে সার নিয়ে ডিলারদের কারসাজি
ঝিনাইদহের শৈলকুপা ও হরিণাকুন্ডু উপজেলায় সার নিয়ে চলছে তুঘলকি কাণ্ড। আর এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন খোদ বিসিআইসি অনুমোদিত সার ডিলাররা। এমন পরিস্থিতিতে জেলার শৈলকুপা ও হরিণাকুন্ডুতে ইউরিয়াসহ অন্য সারের কৃত্তিম সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
শৈলকুপা উপজেলায় পৌরসভাসহ ১৪টি ইউনিয়নে ১৫ জন বিসিআইসি অনুমোদিত সার ডিলার রয়েছেন। আর হরিণাকুন্ডু উপজেলায় পৌরসভাসহ ৮ ইউনিয়নে ১০ জন বিসিআইসি অনুমোদিত সার ডিলার রয়েছেন। এ ছাড়া প্রতি ইউনিয়নে ৯টি ওয়ার্ডে একজন করে মোট ৯ জন সাব-ডিলার রয়েছেন। তবে সরকারের অনুমোদিত এসব ডিলারদের অনেকেই সরকারি নির্দেশনা না মেনে স্ব-স্ব ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ডে না থেকে জেলা-উপজেলা শহরে বসে রমরমা সার বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন।
কৃষকরা জানান, শৈলকুপা, হরিণাকুন্ডুসহ ৬ উপজেলার মাঠে মাঠে চলছে আমন ধান রোপণের ভরা মৌসুম। সংকট দেখিয়ে ডিলাররা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করছেন। সার সংকটের কারণে আমনের আবাদ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির আশঙ্কা প্রান্তিক চাষি ও কৃষকদের। বাজারে ১ হাজার ১০০ টাকার ইউরিয়া সার চাষিরা কিনছেন ১ হাজার ৪০০ থেকে দেড় হাজার টাকা বস্তা দরে। অবশ্য খুব গোপনে এভাবে সার বিক্রি করে আসছেন কতিপয় অসাধু ডিলার ও সাব-ডিলাররা।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সার ডিলারদের ক্যাশ মেমোর মাধ্যমে চাষিদের কাছে সার বিক্রির নিয়ম থাকলেও বেশি দামে বিক্রির কারণে তা করছেন না ডিলাররা। কিছু ডিলার সিন্ডিকেট করে এমন নানা কারসাজি করে আসছেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৯ নম্বর মনোহরপুর ইউনিয়নের সার ডিলার গোলাম নবী, ৮ নম্বর ধলহরাচন্দ্র ইউনিয়নের নিধির সাহা, ১২ নম্বর নিত্যানন্দপুর ইউনিয়নের জগলুল বাদশা বিসিআইসি ডিলার হওয়ার শর্তভঙ্গ করে ২০০৯ সাল থেকে শৈলকুপা শহরে সার বিক্রি করে আসছে।
এ ছাড়া দুই উপজেলায় প্রায় শতাধিক সাব-ডিলার পৌর শহরে বসে সার-কীটনাশক ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। ফলে শহরে এসে কৃষকদের সার কিনতে গিয়ে বাড়তি পয়সা গুণতে হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে সার কীটনাশকের কৃত্তিম সংকট। এমন অবস্থায় চলতি আমন মৌসুমে ইউরিয়াসহ অন্যান্য সারের কৃত্তিম সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
শৈলকুপা ও হরিণাকুন্ডুতে সারের মজুদ ও কালোবাজারির মাধ্যমে অনেক ডিলার রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। এদিকে নির্দিষ্ট গোডাউনে ইউরিয়া সার না রেখে গোপনে সার অন্যত্র সরিয়ে রাখা ও বিক্রির অভিযোগে একজন ডিলারকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে সার-বীজ মনিটরিং কমিটি।
এ ছাড়া সাড়ে ৩০০ বস্তা ইউরিয়া সার ফেরত আনা হয়েছে। গত ৫ আগস্ট শৈলকুপার ৭ নম্বর হাকিমপুর ইউনিয়নের বিসিআইসি সার ডিলার আলম মোল্লার গোডাউনে অভিযান চালিয়ে উপজেলা সার-বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতি ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমা লিজা। এসময় সার-বীজ মনিটরিং কমিটির সম্পাদক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ডক্টর মাহফুজুর রহমানসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
৭ নম্বর হাকিমপুর ইউনিয়নের বিসিআইসি সার ডিলার আলম মোল্লার গোডাউনে অভিযান পরিচালনাকালে কর্মকর্তারা জানতে পারেন, গোডাউনে নির্ধারিত সারের চেয়ে সাড়ে ৩০০ বস্তা ইউরিয়া কম রয়েছে। অভিযোগ ছিল এই সার বিক্রি করে দেওয়া হয় পৌরসভার সাব-ডিলার শমসের মোল্লার কাছে। এমন ঘটনায় তাকে জরিমানা করা হয়। এসময় আলম মোল্লা উপস্থিত না থাকায় তার ছেলে নোমান পারভেজকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় এবং সাড়ে ৩০০ বস্তা সার ফিরিয়ে আনা হয়।
যদিও আলম মোল্লার ছেলে নোমান পারভেজ দাবি করছেন ‘গোডাউনে জায়গা কম থাকায় অন্যত্র সার সরিয়ে রেখেছিলেন, বিক্রির উদ্দেশ্যে নয়। আর বেশি দামে সার বিক্রির দায়ে এ জরিমানা করেছেন’। তিনি দাবি করেন, যা করা হয়েছে সেটি অন্যায়।
এদিকে এক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঝিনাইদহের উপপরিচালক কৃষিবিদ আজগর আলী ও ডিটিও বিজয় কৃষ্ণ হালদার অভিযুক্ত ডিলার আলম মোল্লার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে তদন্তে আসেন। তারা এই ডিলারের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রেজিস্ট্রার, সার বিক্রির মেমো/রিসিভ কপি দেখাতে না পারাসহ নানা অনিয়ম দেখতে পান।
শৈলকুপা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ডক্টর মাহফুজুর রহমান জানান, সরকারের সার ব্যবস্থাপনা আইন ২০০৬ এর ১২(৩) ধারা অনুযায়ী বিসিআইসি সার ডিলার আলম মোল্লাকে (তার অনুপস্থিতিতে) ১৫ হাজার টাকা জরিমানা ও বিক্রি করে দেওয়া সাড়ে ৩০০ বস্তা ইউরিয়া সার ফেরত আনা হয়েছে। এ ছাড়া এই ডিলার বিধি বহির্ভূতভাবে পৌর এলাকার কলেজ রোডে মেসার্স মকবুল এন্টারপ্রাইজ নামে একটি দোকান মালিককে লাইসেন্স ছাড়া কীটনাশক বিক্রির অনুমতি দেয় যা সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূত ও অবৈধ।
তিনি বলেন, কেউ সারের কৃত্রিম সংকট বা সিন্ডিকেটের চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং সার মজুদকারি ও বেশি দামে সার বিক্রির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যহত থাকবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঝিনাইদহের উপপরিচালক কৃষিবিদ আজগর আলী জানান, শৈলকুপার সার ব্যবসায়ী ও বিসিআইসি ডিলার আলম মোল্লা অবৈধ পন্থায় সরকারি সার বিক্রি ও গোডাউন থেকে সার সরিয়ে রেখেছিলেন যা খুবই অন্যায়।
তিনি বলেন, শৈলকুপা উপজেলায় মনোহরপুর ইউনিয়নের সার ডিলার গোলাম নবী, ধলহরাচন্দ্র ইউনিয়নের নিধির সাহা, নিত্যানন্দনপুর ইউনিয়নের জগলুল বাদশা বিসিআইসি ডিলার হওয়ার শর্তভঙ্গ করে ২০০৯ সাল থেকে শৈলকুপা শহরে সার বিক্রি করে আসছেন। এসব আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধেও দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসএন