কৃষিমন্ত্রীর আসনে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি ভাঙতে চায় বিএনপি
মধুপুর ও ধনবাড়ী উপজেলা নিয়ে টাঙ্গাইল-১ আসন গঠিত। টাঙ্গাইল সদর আসনের মতো জেলার রাজনীতিতে এই আসনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৩টি আসন পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও মধুপুর-ধনবাড়ীর আসনটি হাতছাড়া হয়ে যায়। তখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহেন্দ্র লাল বর্মণকে পরাজিত করেন জাসদ মনোনীত প্রার্থী আবদুস সাত্তার। এরপর থেকে এই আসনটি জয়ে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো বেগ পেতে হয়নি।
এ ছাড়াও বিশেষ করে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী এই আসন থেকে বিজয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষিমন্ত্রী ডক্টর মো. আবদুর রাজ্জাক এই আসন থেকে বিজয়ী হওয়ার পর থেকে আসনটি আওয়ামী লীগের ঘাটি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এই ঘাটি ভাঙতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি ও তার সহযোগী অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আগামী নির্বাচনের বৈতরনী পার হতে আওয়ামী লীগকে মাত্রাতিরিক্ত কাঠখড় পোড়াতে হবে। নির্বাচনে আসবে কি-না তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মাঝেও এই আসনে সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করার ব্যাপারে মনোনিবেশ করেছে বিএনপি। উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম সরকারের (সরকার শহীদ) অকাল মৃত্যুতে সাংগঠনিক কার্যক্রমে কিছুটা স্থবিরতা এলেও শোককে শক্তিতে পরিণত করে বিএনপি নেতারা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।
এদিকে ইতিমধ্যে মধুপুর ও ধনবাড়ী উপজেলার সব পর্যায়ের কমিটি গঠন করে সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করেছে। সংগঠনটি নিজস্ব ভোট ব্যাংকের সঙ্গে ক্ষুব্ধ মানুষের ভোট যুক্ত করে বিএনপি আসন পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছে। শোনা যাচ্ছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেতে পারেন বর্তমান এমপি ও সরকারের কৃষিমন্ত্রী ডক্টর মো. আব্দুর রাজ্জাক। তবে এই আসনে তিনি একাই মনোনয়ন চাইবেন এমনটি নয়।
মধুপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মধুপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছরোয়ার আলম খান আবু, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক শামসুন নাহার চাঁপা, টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্সের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার তারেকুল ইসলাম তারেক, কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সহ-সভাপতি রেজাউল করিম হিরণও মনোনয়ন চাইবেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় ১ বছর আগে থেকেই মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় আছেন বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা। ডাকসুর সাবেক সদস্য ও টাঙ্গাইল-১ আসনের সাবেক এমপি খন্দকার আনোয়ারুল হক, দুই নির্বাচনে মনোনীত প্রার্থী বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ফকির মাহবুব আনাম স্বপন, বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী দলীয় মনোনয়ন চাইবেন।
২০০১ সাল থেকে টানা ৪ বার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ডক্টর মো. আব্দুর রাজ্জাকের দখলে আছে আসনটি। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। সুযোগটা কাজেও লাগিয়েছেন এই নেতা। এরই মধ্যে নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় নেতা-কর্মীদের সুসংগঠিত হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এই আসনে কৃষিমন্ত্রী ডক্টর মো. আব্দুর রাজ্জাক অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে লড়তে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন করবে বিএনপি। আলোচনায় উঠেছে আওয়ামী লীগ মনোনীত শক্তিশালী প্রার্থীর সঙ্গে লড়াই করার মতো বিএনপির উপযুক্ত প্রার্থী হচ্ছে নির্বাহী কমিটির সদস্য ফকির মাহবুব আনাম স্বপন।
তবে সাধারণ মানুষের ধারণা, এবার এই আসনে একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে।
জানা গেছে, এই দুই প্রার্থী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে মোট চার বার ভোট যুদ্ধে মুখোমুখি হবেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মো. আব্দুর রাজ্জাক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। সবমিলিয়ে এ আসন থেকে মোট ৪ বার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি।
এদিকে মনোনয়ন পাওয়ার আগেই নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ শুরু করেছেন এই আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। অংশগ্রহণ করছেন বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে। নির্বাচন উপলক্ষে পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন সাটিয়ে মধুপুর ও ধনবাড়ী উপজেলাবাসীকে শুভেচ্ছা জানানোর মাধ্যমে আলোচনায় আসার চেষ্টা করছেন মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। দলীয় মনোনয়ন পেতে জোর লবিং করছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জানান, ডক্টর মো. আব্দুর রাজ্জাক এবারও পাচ্ছেন নৌকার টিকেট। আওয়ামী লীগ এবারো তাকেই মনোনয়ন দেবেন এবং তিনিই বিজয়ী হবেন।
ধনবাড়ীতে ৫০ শয্যা হাসপাতাল, মডেল উপজেলা ও থানা ভবন, ফায়ার সার্ভিসসহ নানা উন্নয়নের কথা বলে তারা জানান, সিদ্দিকী ও খান পরিবার কোণঠাসা হয়ে পড়ায় ডক্টর মো. আব্দুর রাজ্জাকই কেন্দ্রীয় সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে বর্তমানে আওয়ামী রাজনীতির টাঙ্গাইলের অভিভাবক। এ আসনে তার বিকল্প প্রার্থী নেই বলেও জানান বেশিরভাগ দলীয় নেতা-কর্মীরা।
বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী জানান, বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক বৃহৎ রাজনৈতিক দল। দলে একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকতেই পারেন। তবে দল থেকে ফকির মাহবুব আনাম স্বপন মনোনয়ন পাচ্ছেন। তাদের ধারণা, কেন্দ্র দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করবেন। আর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ফকির মাহবুব আনাম স্বপন জয়লাভ করবে।
জাতীয় পার্টি (জাপা) থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন মধুপুর উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি সার্জেন্ট (অব.) মোহাম্মদ আলী। এ ছাড়াও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মধুপুর উপজেলা শাখার সহ-সভাপতি মাওলানা জহিরুল ইসলাম দলের মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে কৃষিমন্ত্রী ডক্টর মো. আব্দুর রাজ্জাক জানান, বিগত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তার নির্বাচনী এলাকা ধনবাড়ী-মধুপুরে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। ধনবাড়ীতে মডেল উপজেলা ভবন, ৫০ শয্যার হাসপাতাল, থানা ভবন, ফায়ার সার্ভিস, প্রাণী হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, সড়ক নির্মাণ, মধুপুরে ৭২ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন অত্যাধুনিক সাইলো নির্মাণ, মধুপুর অডিটরিয়ামসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। দুই উপজেলার প্রতিটি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছেন। বিপুল এই উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে মধুপুর-ধনবাড়ীর প্রতিটি মানুষ। মধুপুর-ধনবাড়ী উপজেলা এখন উন্নয়নের রোল মডেল।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ফকির মাহবুব আনাম স্বপন জানান, তাদের নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়নের মধ্যে দিয়ে তারা সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছেন। দলের হাই-কমান্ডের নির্দেশনা মেনে কাজ করছেন। দল তাকে মূল্যায়ন করবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে পারলে এই আসনে বিএনপি প্রার্থী অবশ্যই জয়ী হবে।
প্রসঙ্গত, টাঙ্গাইল-১ আসনটি মধুপুর উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১১টি ইউনিয়ন এবং ধনবাড়ী উপজেলার একটি পৌরসভা ও সাতটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। আগের তালিকা অনুযায়ী এই আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৪৭ জন।