ইতালি যাওয়ার নেশায় সাগরে ডুবেছেন মাদারীপুরের শতাধিক যুবক
মৃতদের কয়েকজন। ছবি: সংগৃহীত
দালালদের প্রলোভনে পড়ে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার সময় সাগরে ডুবে গত ১০ বছরে মাদারীপুরের শতাধিক যুবকের প্রাণহানি ঘটেছে। কেউ জীবন নিয়ে বেঁচে ফিরলেও সইতে হয়েছে নির্মম নির্যাতন। দালালদের প্রলোভনে ইতালী পাঠাতে গিয়ে সন্তান হারানোর পাশাপাশি নিঃস্ব হচ্ছে জেলার অসংখ্য পরিবার! গত ১০ বছরে মাদারীপুরে ৩২৯টি মানবপাচার মামলা হয়েছে। তবে মামলার একটিরও বিচার হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
ভুক্তভোগী পরিবার সূত্র ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুর্ঘটনায় প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটলেও অবৈধপথে ইতালী যাওয়ার প্রবণতা কমেনি। ফলে ভূমধ্যসাগর নৌকাডুবিতে বাড়ছে প্রাণহানি। গেল ১০ বছরে তিউনিসিয়ায় নৌকাডুবিতে মারা যাওয়াদের মধ্যে মাদারীপুরের রয়েছে শতাধিক যুবক। এখনো নিখোঁজ অনেকে। সবশেষ গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তিউনিসিয়ায় নৌকায় আগুন ধরে মারা যাওয়া আট বাংলাদেশির মধ্যে পাঁচজনই মাদারীপুরের বাসিন্দা।
স্থানীয়রা জানায়, এলাকার অল্প বয়সী তরুণ ও যুবকেরা পড়ে দালালের খপ্পরে। দালালদের প্রলোভনে ভিটেমাটি বিক্রি করার পাশাপাশি সুদে টাকা এনেও সন্তানদের অবৈধভাবে বিদেশে পাঠায় অভিভাবকরা। দুর্ঘটনায় আদরের সন্তান মারা যাওয়ায় নিঃস্ব হয় পরিবারগুলো।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, 'দালালচক্রকে নির্মূল না করায়, একের পর এক নৌকাডুবিতে মারা যাচ্ছে মানুষ। প্রতিরোধে প্রয়োজন জনপ্রতিনিধিদের আন্তরিকতা আর সচেতনতা বৃদ্ধি করা। '
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় জেলাজুড়ে গড়ে উঠেছে একাধিক দালালচক্র। থানায়ও রয়েছে বড় সিন্ডিকেট।
জেলা পুলিশের তথ্য মতে, গত ১০ বছরে মাদারীপুরে ৩২৯টি মানবপাচার মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মীমাংসা হয়েছে ১১১টি মামলার। বিচার হয়নি একটিরও। এমন দুর্ঘটনায় নিহতের স্বজনদের অনেক সময় মামলাও করতে দেয়নি দালালচক্র। সামান্য কিছু টাকা দিয়ে মীমাংসার চেষ্টা চালায় তারা। এতে কমছে না এমন দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা।
একাধিক সূত্র জানায়, ২০১৩-২০২৩ এই ১০ বছরে মাদারীপুরে আদালত ও থানায় মানবপাচারের মোট মামলা হয়েছে ৩২৯টি। এর মধ্যে জেলার বিভিন্ন থানায় মামলার সংখ্যা ২৯২টি ও আদালতে ৩৭টি মামলা দায়ের হয়। মামলায় মোট আসামি ১৪৬৬ জন হলেও গ্রেপ্তার হয় মাত্র ২৮৭ জন। আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয় ৯৬টি মামলার, আর আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা পড়ে ৮৭টি মামলার। এছাড়া এখন পর্যন্ত ১১১টি মামলা মীমাংসা হওয়ায় বাদী মামলা প্রত্যাহার করেছেন। গত ১০ বছরে অবৈধপথে ইতালী পাড়ি জমিয়েছে ৫৫০০ জন।
বিভিন্ন মামলা, ভুক্তভোগী স্বজন ও জেলা পুলিশ সূত্রে দালালদের তালিকায় যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন- গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের সুন্দরদী গ্রামের মোশারফ কাজী, একই উপজেলার গজারিয়া গ্রামের রহিম শেখ, মাদারীপুর সদর উপজেলার কুমড়াখালী গ্রামের এমদাদ বেপারী, একই উপজেলার বড়াইলবাড়ীর জামাল খান, দক্ষিণপাড়ার সামাদ বেপারী, চর-নাচনার আতিবর মোড়ল ও কাশেম মোড়ল, বড়াইলবাড়ী গ্রামের সবুজ মীরা, জামাল খান, রুবেল খাঁ, সুমন মীরা, শ্রীনাথদি বাজিতপুরের জাহাঙ্গীর হাওলাদার, চাছার গ্রামের ইউসুফ খান জাহিদ, নয়াচর গ্রামের মহসিন মাতুব্বর ও মিজান মাতুব্বর, পেয়ারপুরের আম্বিয়া বেগম ও সবুর খান, গাছবাড়িয়া গ্রামের নাসির শিকদার, রাজৈর উপজেলার বদরপাশা গ্রামের জুলহাঁস তালুকদার, একই উপজেলার তেলিকান্দি গ্রামের মনিকা বেগম, শাখারপাড়ের কামরুল মোল্লা ও এমরান মোল্লা, আমগ্রাম কৃষ্ণারমোড় এলাকার শামীম ফকির ও সম্রাট ফকির, শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া এলাকার শহিদুল মাতুব্বর ও সিরাজ মাতুব্বর।
মানবাধিকার কর্মী মশিউর রহমান পারভেজ বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে অবৈধপথে ইতালীতে যাওয়ার সময় মাদারীপুরের যুবকরা মৃত্যুর মুখে পড়ে যায়। অনেক সময় মারাও গেছে অনেকেই। দালালদের বিচার না হওয়ার কারণে এই অপরাধ কমছে না। মানবপাচারের ঘটনায় দালালদের কঠিন বিচার হলে সমাজ থেকে এই অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব। '
মাদারীপুর আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুলাহ আল মামুন বলেন, 'এলাকাভিত্তিক গড়ে উঠেছে দালালচক্র। এই চক্রটি শক্তিশালী হওয়ায় বাদীকে অনেক সময় মামলা তুলে নিতে ভয়ভীতি দেখায়। এতে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে দালালরা। '
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম জানান, 'শুধু আইনের প্রয়োগ করেই দালালকে নির্মূল করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন, পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে সমাজ থেকে দালাল নির্মূল হবে। এছাড়া মানবপাচার মামলায় অনেক দালাল গ্রেপ্তারের পর জামিনে বেরিয়ে এসে আবারো একই কাজে লিপ্ত হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুললেই এই ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি হবে না। '