আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবা
প্রতিদিন কয়েকশ মানুষ উন্নত চিকিৎসা সেবা পাওয়ার আশায় ছুটে আসেন কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালের নিম্নমানের চিকিৎসা সেবা এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিয়ে রোগীদের যেমন অভিযোগ আছে, ঠিক তেমনই জনবল স্বল্পতার কারণ দেখাচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
বিশেষ করে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবলের সংকট চরমে। এছাড়া সমস্ত হাসপাতাল জুড়ে রয়েছে দালালদের দৌরাত্ম। চিকিৎসা সেবার নামে রোগীদের হয়রানির অভিযোগও উঠেছে নানা সময়ে। কিন্তু কোনোা উপায় না থাকায় বাধ্য হয়ে সবকিছু সহ্য করেন সেবা নিতে আসা রোগীরা।
ইতোপূর্বে দালালদের দৌরাত্ম ঠেকাতে প্রশাসন ভ্রাম্যমান অভিযান পরিচালনা করে। তবে গত দুই বছরে বিশেষ করে করোনাকালে প্রশাসনের কার্যক্রম চোখে পড়ে না বললেই চলে। হাসপাতাল চত্বরে একটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন প্রকার অনিয়ম রোধকল্পে। পুলিশ ক্যাম্পের কর্মকর্তারাও বিভিন্ন সময়ে অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। ফলে বিভিন্ন সময়ে তাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড, বারান্দা এবং শৌচাগারে যেমন ময়লা-আবর্জনায় পূর্ণ। তেমনি হাসপাতাল ভবনের বাইরেও ময়লা-আবর্জনা বিভিন্ন স্থানে স্তুপ হয়ে রয়েছে। হাসপাতাল ভবনের পশ্চিম পাশের ড্রেনের মধ্যে ময়লা আবর্জনা পঁচে রীতিমতো দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে৷ অনেককে ড্রেনের পাশে প্রসাব করতেও দেখা যায়।
এদিকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন যাবৎ ১২ জন চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে। যার ফলে ৪৮ জন চিকিৎসক নিয়ে চিকিৎসা সেবা চলমান। আর তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আছে ৪৯ জনের পরিবর্তে ৩৩ জন, এখানেও শূন্য পদের সংখ্যা ১৬। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ৪৮ জনের জায়গায় বর্তমানে আছে শুধুমাত্র ১৪ জন, ৩৪টি পদ বর্তমানে শূন্য। অফিস সহায়ক হিসাবে ২০ জন থাকার কথা, আছে মাত্র ৭ জন, যার ফলে ১৩টি পদ শূন্য। স্ট্রেচার বেয়ারার ২ জন থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে শূন্য। কুক বা মশালচি পদে ৬ জন থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে কেউ নাই। পরিচ্ছন্নতা কর্মী ১৬ জনের জায়গায় আছে মাত্র ৪ জন। যার ফলে ১২টি শূন্য পদ বিদ্যমান এবং ১৬ জনের কাজ ৪ জনকে সামাল দিতে হচ্ছে।
সর্বশেষ ৩১ নভেম্বর ২০২১ তারিখে জেলা প্রশাসক বরাবর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কার্যক্রম সম্পর্কিত বিভাগীয় কমিশনার সভায় সমন্বয় সভার কার্যবিবরণী বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রেরণ করা হয়। যার স্মারক নং জেঃ/হাসঃ/কুষ/শা-১/২০২১। সেখানে হাসপাতালের শুদ্ধাচার এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে আর হাসপাতালের সকল কর্মকর্তা/কর্মচারীদের সমন্বয়ে মিটিং করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার উন্নতি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে মোতাবেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম অব্যাহত আছে বলে জানানো হয়। পয়নিষ্কাশন, ল্যাট্রিন মেরামত এবং নষ্ট রোড মেরামতের ব্যাপারে নির্বাহী প্রকৌশলী, গণপূর্ত বিভাগ কুষ্টিয়াকে মৌখিক এবং লিখিত পত্র প্রেরণ করা হয়েছে বলেও অবহিত করা হয়।
এছাড়াও ৮৪ জন আউট সোর্সিং কর্মীর নিয়োগের মাধ্যমে হাসপাতালের জনবল বৃদ্ধির জন্য উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে মর্মে উল্লেখ করা হয়। তবে সেই ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায় নাই মর্মেও জানানো হয়েছিলো।
হাসপাতাল সূত্রে আরও জানা যায়, হাসপাতাল আঙিনার ডেঙ্গু মশা নিধনসহ বিভিন্ন ছোটখাটো বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পৌরসভার উপর নির্ভরশীল। ময়ূর চত্ত্বর থেকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের প্রবেশ পথটি বর্ষা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবে যায়। যার ফলে হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগী এবং রোগীর স্বজনদের পোহাতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগ।
জলাবদ্ধতা নিরসনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সর্বশেষ ২৪ জুন ২০২১ ইং তারিখে কুষ্টিয়া পৌরসভার মেয়র বরাবর চিঠি প্রদান করে। যার স্মারক নং জেঃ/হাসঃ/কুষ/শা-৬/২০২১। কিন্তু পৌর কর্তৃপক্ষ ময়ূর চত্ত্বর থেকে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের প্রবেশ পথটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীন সড়ক উল্লেখ করে আর্থিক সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রকৌশল বিভাগ কর্তৃক নির্মানের জন্য অনুরোধ করে পাশ কাটিয়ে যান।
২০১৭ সালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ৪ জন সুইপার পদায়নের জন্য পৌর কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠালে জনবল সংকটের কারণ দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে সুইপার না দিতে পারায় দুঃখ প্রকাশ করে পৌর কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতালে সামান্য পার্টিশন দেওয়া, রেলিং সংস্কার, ট্যাংক পরিস্কার, বসে যাওয়া স্লাপ ঠিক মেরামত করার জন্য গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর অনুমোদন নিতে হয়। সামান্য এই সমস্ত কাজের জন্য চিঠি চালাচালি করতেই চলে যায় মাসের পর মাস। আবার কখন পেরিয়ে যায় বছর। অন্যান্য বড় কাজের কথা না হয় বাদই দেওয়া যাক। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল, গণপূর্ত বিভাগ এবং কুষ্টিয়া পৌরসভার আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে হাসপাতালের উন্নয়ন সব সময়ই অবহেলিত বলে প্রতীয়মান হয়।
এই সমস্ত বিষয়ে কুষ্টিয়া গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৗশলী মো. জাহিদুল ইসলামকে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। যে কারণে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
কুষ্টিয়া পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, হাসপাতালের অভ্যন্তরীন যে ড্রেন আছে তা খুব সরু। হাসপাতালে পূর্ব দিকে গোরস্থানের দিকে পৌরসভার ড্রেনের সঙ্গে হাসপাতালের অভ্যন্তরীন ড্রেন যুক্ত হয়েছে। সেই ড্রেনের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং গভীরতা কম। যার ফলে বর্ষা মৌসুমে পানি গিয়ে কভার করতে পারে না এবং হাসপাতালের ভিতরে এবং বাইরে জমে থাকে।
প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম আরও বলেন, ‘হাসপাতাল ভবন অনেক পূরাতন হাওয়ার কারণে ভবনের ফ্লোর লেভেল অনেক নিচু। যার ফলে ভবনের অভ্যন্তরে ওয়াটার লকিং হয়ে যায়। যার ফলে দীর্ঘ সময় তারা জলাবব্ধতায় ভোগে এবং পুরাতন ভবনের ফ্লোরে পানি উঠে যায়। আমরা এই কথা তাদের লিখিতভাবেও জানিয়েছি যে, হাসপাতালের এই অভ্যন্তরীন ড্রেনগুলো নির্মাণ করবে পিডব্লিউডি অথবা হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট। হাসপাতালের বাইরে থেকে পানি বের করার দায়িত্ব আমাদের এবং সেই ব্যবস্থা করা আছে। আমাদের নতুন প্রজেক্টে হাসপাতাল রোড এক নাম্বারে আছে।’
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. আবদুল মোমেন বলেন, 'হাসপাতালটি ৫০ শয্যা থেকে পর্যায়ক্রমে ২৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবলের সংকট। শূন্য পদ পূরণ অথবা আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবলের সংকট পূরণের জন্য কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি।'
এসএ/এএন