৮ বছর বয়সেই মুক্তিযোদ্ধা, ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি স্থানীয়দের
খুলনার তেরখাদা উপজেলায় মাত্র ৮ বছর বয়সে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন মর্মে সনদপত্র জমা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হয়েছেন গাউস মোল্লা নামে এক ব্যক্তি। তিনি উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের কোলা পাটগাতী গ্রামের মো. ইমান উদ্দিন মোল্লার ছেলে। তার জাতীয় পরিচয় পত্র মোতাবেক জন্ম তারিখ ১৯৬৩ সালের ১লা জানুয়ারি। এত অল্প বয়সে প্রতিবেশী দেশে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং দীর্ঘ ৩৪ বছর পর ২০০৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হওয়ায় তীব্র সন্দেহ ও রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি মুক্তিযোদ্ধা কি-না সে বিষয়ে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে জেলা প্রশাসক, স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
লিখিত অভিযোগে জানা গেছে, তেরখাদা উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের কোলা পাটগাতী গ্রামের গাউস মোল্লা জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯৬৩ সালের ১লা জানুয়ারি। জন্ম তারিখ অনুযায়ী মাত্র ৮ বছর বয়সে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। গাউস মোল্লা এত অল্প বয়সে ভারতে ট্রেনিং করেছেন মর্মে দাবি করে মুক্তিযোদ্ধা সনদপ্রাপ্তও হয়েছেন। গাউস মোল্লার জাতীয় পরিচয় পত্র (নম্বর ৭৭৭২৯১৩০৫৪) অনুযায়ী জন্ম ১৯৬৩ সালের ১লা জানুয়ারি, যার বীর মুক্তিযোদ্ধা নম্বর ০১৪৭০০০১৬৬৫, লাল মুক্তিবার্তা নম্বর ৪০২০২০০১৬, গেজেট নম্বর-১৬, সূচক নম্বর-৪৭-৯৪-২৭-০২৩ ব্যবহার করে ২০০৫ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সুবিধা গ্রহণ করছেন। ১৯৭১ সালে মাত্র আট বছর বয়সে সে কিভাবে প্রতিবেশী দেশ ভারতে গিয়ে ট্রেনিং গ্রহণ ও মুক্তিযোদ্ধা হলো তা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
স্থানীয়রা বলছেন, আসলেই কি গাউস মোল্লা মুক্তিযুদ্ধ করেছে? নাকি টাকার বিনিময়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে সে মুক্তিযোদ্ধা সনদ অর্জন করেছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদী বরবার লিখিত অভিযোগ করেছেন তেরখাদা উপজেলার বারাসাত গ্রামের এম এ আলম। তিনি অভিযোগে গাউস মোল্লা এত অল্প বয়সে আদৌ ভারতে ট্রেনিং করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে কি-না সে বিষয়ে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করেছেন। একই সঙ্গে তিনি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, খুলনার জেলা প্রশাসক, খুলনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার, তেরখাদা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বরাবরও আবেদন করে অভিযোগ জানিয়েছেন।
অভিযোগে আরও জানা গেছে, গাউস মোল্লা বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে এলাকায় বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে লিপ্ত রয়েছেন। এমনকি প্রতিবেশী সনাতন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের লোকজনকে প্রতিনিয়ত মামলার ভয় দেখিয়ে হয়রানি করছেন এই তথাকথিত বীর মুক্তিযোদ্ধা। এতদিন বিষয়টি গোপন থাকলেও সম্প্রতি তার জাতীয় পরিচয়পত্র, মধুপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ মো. মোহসিন প্রদত্ত স্থায়ী বাসিন্দার সার্টিফিকেট, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তেরখাদা উপজেলা কমান্ড কর্তৃক প্রদত্ত প্রত্যয়ন পত্রে দেওয়া জন্ম তারিখ সম্বন্ধে জানার পর এলাকাবাসী মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়।
অভিযোগকারী এম এ আলম জানান, গাউস মোল্লার ১৯৬৩ সালে জন্ম গ্রহণ করে মাত্র ৮ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। এটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এমনকি তিনি ওই বয়সে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতে ট্রেনিং করেছেন বলেও দাবি করেন। তিনি প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযোদ্ধা হলে স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৩৪ বছর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হননি কেন? একই সাথে হঠাৎ করে ২০০৫ সালে বিএনপি-জামায়াত শাসন আমলে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভূক্ত হলেন সে বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। সেই সাথে মুক্তিযোদ্ধা গাউস মোল্লা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাপট দেখিয়ে এলাকাতে বিভিন্ন অপকর্মের সাথে লিপ্ত রয়েছে। এমনকি এলাকার মানুষের প্রতি বিভিন্নভাবে জুলুম নির্যাতন করে আসছে। এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অন্তরালে থেকে যাচ্ছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যথাযথ সম্মান পাচ্ছে না। এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা দেশের টাকায় ভাতা পাচ্ছে। তাই দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে তথ্যের সঠিকতা নিরূপণের জন্য আবেদন করেছি।
তিনি আরও জানান,গাউস মোল্লার বড় বোন বড়ু বিবির জন্ম তারিখ জাতীয় পরিচয়পত্র অনুসারে ১৯৫৭ সালে। তাহলে তার জন্ম ১৯৫২ সালে হয় কিভাবে। যা প্রশাসন তদন্ত করলে প্রকৃত ঘটনা বের হয়ে আসবে।
এ বিষয়টি নিয়ে গাউস মোল্লার বড় বোন বড়ু বিবি জানান, আমরা ৭ ভাই-বোন। তার মধ্যে গাউস মোল্লা আমার ৪ বছরের ছোট। আমার জন্ম ১৯৫৭ সালে হলে তার জন্ম ১৯৫২ সালে কিভাবে হয়। তবে সে মুক্তিযুদ্ধা কিনা আমি বলতে পারব না বলে জানান তিনি। যার কারণে বিষয়টি নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধা গাউস মোল্লা জানান, জাতীয় পরিচয়পত্র অনুসারে তার প্রকৃত জন্ম তারিখ ছিল ১৯৫২ সালের পহেলা জানুয়ারী। যার সব প্রমাণ তার রয়েছে। কিন্তু আর্থিক ভাবে অসচ্ছল হওয়ায় ব্যাংকে চাকরি করার প্রয়োজনে বয়স কমিয়ে ১৯৬৩ সালের পহেলা জানুয়ারি করেছিলেন, যা পরবর্তীতে আর ঠিক করা হয়নি। তাছাড়া একজন মুক্তিযুদ্ধা হিসেবে লাল মুক্তিবার্তাসহ সকল কাগজপত্র রয়েছে বলে জানান তিনি ।
এ প্রসঙ্গে তেরখাদা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা চৌধুরী আবুল খায়ের জানান, শুনেছি মুক্তিযোদ্ধা গাউস মোল্লার ভোটার আইডি কার্ডে বয়স কম। প্রকৃত পক্ষে মুক্তিযোদ্ধা হতে সাধারণত যে বয়স প্রয়োজন তার সেই বয়স ছিল না। কারণ মাত্র ৮ বছর বয়সে কেউ মুক্তিযোদ্ধা হয় না। যদি কোনো মুক্তিযোদ্ধার জাতীয় পরিচয় পত্রে বয়স কম থাকে তাহলে তাকে জন্ম সনদ ও শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট দেখিয়ে তা প্রমাণ করতে হবে।
অন্যদিকে গাউস মোল্লার বিচার দাবি করেছেন প্রতিবেশীরা। কাকলী লস্কর নামে তার এক প্রতিবেশী জানান, গাউস মোল্লা আমাদের নামে বিভিন্ন মামলা করার হুমকি দিচ্ছে। তার নির্যাতনে প্রতিবেশীরা ঠিকভাবে বসবাস করতে পারছে না। আমরা এ ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার বিচার চাই।
এসব ব্যাপারে খুলনার জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফিন জানান, আমরা এ বিষয়ে একটি অভিযোগ পেয়েছি। আসলে বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষ বিষয়। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তদন্তের পরে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এসআইএইচ