যশোর জেলার ১১৮ ইটভাটার নেই কোনো বৈধতা
যশোর অঞ্চলে ২৯১টি ইটভাটা থাকলেও ১১৮টি ভাটার কোনো বৈধতা নেই। পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে এসব ইটভাটা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ইটভাটা ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার পরও পেশী শক্তির জোরে চলছে তাদের ইটভাটা। জেলা প্রশাসকের ইট পোড়ানো লাইসেন্স পর্যন্ত নেই এসব ইট ভাটার। আইনগতভাবে জিগজ্যাগ পদ্ধতিতে চলছে মাত্র ৫২টি ইট ভাটা।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশ আইন অনুযায়ী যশোরের বেশিভাগ ইটভাটার বৈধতা না থাকায় আন্ত মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে অধিদপ্তর। পরিবেশ আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী ভাটা পরিচালনা কার্যক্রম হাল নাগাদ করতে নোটিশ করা হচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অবৈধ ইটভাটাগুলো উচ্ছেদে কাজ শুরু হবে বলে বলে হুঁশিয়ারি করে দিয়েছেন যশোরের উপ পরিচালক সাঈদ আনোয়ার।
আরও জানা যায়, ২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে সংশোধনী এনে ইট ভাটার জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা হয়। লাইসেন্সবিহীন ইট ভাটা চালালে দুই বছরের জেল। এ ছাড়া আইন না মেনে ভাটা চালালে ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান সংযোজন করা হয়। এমনকি ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা (নিয়ন্ত্রণ) সংশোধন আইন, ২০১৯’ বিল সংসদে পাসও হয়। ওই বিলের ধারা ৪ এ সংশোধনী এনে প্রতিস্থাপন করে বলা হয় ‘আপাতত চলমান অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাক না কেন, ইটভাটা যে জেলায় অবস্থিত সেই জেলার জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে অবশ্যই ইট পোড়ানোর লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়াও পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কার্যালয় থেকে পরিবেশের ছাড়পত্র নিতে হবে। এর অন্যথা হলে কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করতে পারবেন না।
এ ছাড়াও পরিবেশ আইন অনুযায়ী আবাসিক এলাকা, সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বন, বাগান জলাভূমি, কৃষি জমি, বিশেষ কোনো স্থাপনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা অনুরূপ কোন স্থান বা প্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে ১ কিলোমিটার বা ১ হাজার মিটার দূরত্বে ইটভাটা স্থাপন করার কথা বলা হয়। সেইসঙ্গে ভাটাগুলো জিগজ্যাগ পদ্ধতির হতে হবে। কিন্তু যশোর জেলার অধিকাংশ ইটভাটার ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটে চলেছে। আইনে ব্যত্যয় ঘটলেও অনেকে ছাড়পত্র ছাড়াই ভাটা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও বিধি অনুযায়ী পরিবেশ আইন কার্যকর হওয়ার সময় থেকে নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান ও এলাকার সীমানার অভ্যন্তরে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। এর জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কোনোরূপ অনুমতি বা ছাড়পত্র বা লাইসেন্স দিতে পারবে না। এরপরও অনেকেই নানা বাঁকা পথে হাসিল করেছেন ছাড়পত্র।
তথ্য মিলেছে, যশোরের এমন ইটভাটাও রয়েছে যার এক কিলোমিটারের মধ্যে নয়, ২০ গজের মধ্যেই রয়েছে বসতবাড়ি, ১০০ গজের মধ্যে রয়েছে ঘনবসতি গ্রাম। প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনো শর্ত মানা হয়নি। সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে চলছে কয়েকটি ইটভাটা। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। আবাসিক এলাকায় ধানী ও কৃষি জমি নষ্ট করে তৈরি করা হয়েছে এসব ইটভাটা। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কবরস্থান ও মসজিদ, শতাধিক পরিবারের বসতি গ্রামসহ অনেক প্রতিষ্ঠান দূষণের কবলে পড়েছে । পরিবেশ আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ইটভাটা নির্মাণ করা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর যশোরের একটি সূত্র জানায়, এই তালিকায় যশোরে পড়েছে ১১৯টি। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি ইটভাটা জিগজ্যাগ হলেও সেখানে পরিবেশগত আইন মানা হয়নি, শর্ত পূরণ না করেই চলছে। যে কারণে অবৈধ তালিকায় পড়েছে ওই ভাটাগুলো। এদের মধ্যে একটি ইটভাটা বন্ধ হয়ে গেছে। ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত একটি সার্ভে করে এর আগে ৩৩টি ইটভাটার ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকা সদর দপ্তরের মনিটরিং ও ইনফোর্সমেন্ট শাখায় প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছিল। আইনগত বৈধতা না থাকায় ওই ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে। পরে ওই ৩৩টি ভাটার প্রতিটিকে দেড় লাখ টাকা থেকে ৫ লাখ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করে সতর্ক করা হয়। সেইসঙ্গে দ্রুত ইটভাটা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। ওই ভাটাগুলোর ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। রয়েছে নানা স্থাপনা। নষ্ট হয়েছে কৃষি জমি, প্রতিকূল প্রভাব পড়ছে আবাসিক এলাকায়ও। এর মধ্যে ভাই ভাই ব্রিক্স, বিশ্বাস ব্রিক্স, বানী ব্রিক্স, মেসার্স যশোর ব্রিক্স, ফিরোজ ব্রিক্স, মুন ব্রিক্স, শরীফ ব্রিক্স, রানা ব্রিক্স, ন্যাশনাল ব্রিক্স, সোহাগ ব্রিক্স, নিউ বোল্ড ব্রিক্স, বন্ড ব্রিক্স, এনপি ব্রিক্স, জাহাঙ্গীর ব্রিক্স, পয়েন্ট ব্রিক্স, নিউ ব্রিক্স, এসএন ব্রিক্স, নিউ ফাইফ স্টার, নিউ ফাইভ স্টার ২, মেঘনা ব্রিক্স, আশা ব্রিক্স, সুপার ব্রিক্সসহ ৩৩টি ইট ভাটার নাম ছিল। এগুলোর উপর নজরদারি ছাড়াও সনাতনী ১৩টি ভাটাসহ আরো ৯৯টি ভাটাতে অভিযান পরিচালনার জন্য হুঁশিয়ারি দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর যশোর।
যশোরের পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, আইনগতভাবে না হওয়ায় ও পরিবেশ আইনের ব্যতয় ঘটায় ২০২০ সাল থেকে ২০২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২১টি ইটভাটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। একে একে বাকিগুলো উচ্ছেদ করে দেওয়া হবে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক। এ ছাড়া জেলার যে ৫২টি ইটভাটা বৈধ বলে খাতা-কলমে রয়েছে তাদের ব্যাপারেও নতুন করে খোঁজ-খবর নেবে পরিবেশ অধিদপ্তর যশোর। এগুলো জিগজ্যাগের হাইব্রিড, হকম্যান, টানেল, কিলন পদ্ধতির ভাটা কি-না। এ ছাড়াও সার্ভে করে পরিবেশ অধিদপ্তর জানতে পেরেছে বিধি ও পরিবেশের বত্যয় ঘটিয়ে চলছে এখন ১১৮টি ইটভাটা। এগুলোর বিরুদ্ধে একে একে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর যশোরের উপ পরিচালক সাঈদ আনোয়ার জানিয়েছেন, ইটভাটা সংক্রান্ত সব অসংগতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে মাঠে নামা হয়েছে। সকল প্রকার দেন দরবার উপেক্ষা করে জনস্বার্থে ও এলাকার পরিবেশ সমুন্নত রাখতে অবৈধ সব ভাটা উচ্ছেদে কাজ শুরু হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দু:খজনক হলেও সত্য যে যশোরে এখন ১৭০টি চলমান ভাটার মধ্যে ১১৮ টির কোনো বৈধতা নেই। এ ব্যাপারে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় যেসব সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে তা নিয়ে কাজ চলছে। যশোরে কোনো অনিয়ম মেনে নেওয়া হবে না।
এসআইএইচ