উদ্যোগের ৩৪ বছরেও চালু হয়নি বগুড়া বিমানবন্দর
বগুড়ায় বিমানবন্দর স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। তার পর ৩৪ বছর কেটে গেছে, বাণিজ্যিকভাবে বিমানসেবা চালু হয়নি। তার পরিবর্তে বর্তমানে সেখানে চলছে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ স্কুলের কার্যক্রম। শিল্পোদ্যোক্তাসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ দ্রুত বগুড়ায় বাণিজ্যিক বিমান চালুর জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন।
বগুড়ায় বিমান চলাচল শুরু হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। গত বছরের ১৫ নভেম্বর (২০২১) এ বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) একটি প্রতিনিধি দল। তারা বগুড়া বিমানবন্দর পরিদর্শন করেছেন। বেবিচক সদর দপ্তরের প্রশাসন বিভাগের উপ-পরিচালক (সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা) বেগম ইশরাত জাহান পান্নার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল বগুড়া এসেছিলেন।
সর্বশেষ বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক ইশরাত জাহান পান্না ঢাকাপ্রকাশকে জানান, গত ১৮ নভেম্বর বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমানের কাছে এ ব্যাপারে একটি রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। তিনি আশা করছেন, আগামী অর্থবছরে বন্দরের অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বগুড়ায় বিমানবন্দর স্থাপনের জন্য ১৯৮৭ সালে সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময় তা নানা জটিলতায় আটকে যায়। পরে ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে বিএনপি সরকারের শেষ দিকে এখানে বিমানবন্দর স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। এ জন্য ২২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়। ১৯৯৫ সালে সদর উপজেলার এরুলিয়া এলাকায় বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়কের পাশে ১০৯ দশমিক ৮১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।
আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পের আওতায় রানওয়ে, কার্যালয় ভবন ও কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণ, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় সব অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়। ২০০০ সালের দিকে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে বিমান আর ওড়েনি। পরে সেখানে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র চালু করা হয়।
বর্তমানে সেখানে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ করছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) শিল্প মালিক সমিতির জেলা সভাপতি আইনুল হক বলেন, বগুড়া বিমানবন্দরে বাণিজ্যিক বিমানসেবা চালু হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্ভাবনার দুয়ার আরও বিস্তৃত হবে। এখানে যোগাযোগ, পরিবেশ, পাইপলাইনে গ্যাসসহ নানা কারণে শিল্পের অনুকূল পরিবেশ বিরাজমান আছে। শুধু বিমানযোগাযোগ সুবিধা না থাকায় বিদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না।
বগুড়ায় বাণিজ্যিক বিমানসেবা চালুর জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন জেলার ব্যবসায়ীদের সংগঠন শিল্প ও বণিক সমিতিসহ শিল্পোদ্যোক্তারা। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক মানের খেলা আয়োজন করার জন্যও এ এলাকায় বিমানবন্দরটি চালু হওয়া দরকার।
বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের মাসুদুর রহমান মিলন বলেন, এ স্টেডিয়াম আইসিসি থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যুর মর্যাদা পেয়েছিল। ক্রিকেটারদের যাতায়াতের সমস্যাসহ নানা কারণে এ ভেন্যুতে দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক কোনো ম্যাচ হচ্ছে না। এখন আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন করতে গেলে নতুন করে আইসিসির কাছ থেকে স্বীকৃতি নবায়ন করতে হবে। বিমানসেবা চালু ছাড়া কোনোভাবে তা আদায় করা সম্ভব না।
জানতে চাইলে বগুড়ার শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি মো. মাছুদুর রহমান বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-অর্থনীতি, কৃষিসহ সব দিক থেকে এগিয়ে বগুড়া। বগুড়ায় ভারী শিল্পকারখানা তেমন না থাকলেও গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানা। বিশেষ করে কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনে বগুড়া দেশের মধ্যে রেকর্ড গড়েছে। মোট উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রাংশের ৮০ ভাগই বগুড়ায় উৎপাদন হচ্ছে। নতুন শিল্পোদ্যোক্তারাও এখানে শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসছেন। অর্থনৈতিক অঞ্চলও হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা আরও বাড়ছে। এসব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাণিজ্যিক বিমানসেবা চালু করা জরুরি।
মাছুদুর রহমান বলেন, সড়কপথে ঢাকা থেকে বগুড়া আসতে ১০ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। পথের ভোগান্তির কারণে বগুড়ায় কোনো বিদেশি ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও রপ্তানিকারকেরা আসতে চান না। বিদেশি ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা না এলে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন তেমন কাজে আসবে না। তা ছাড়া অনেক মানুষ এখন বগুড়া থেকে সড়কপথে ঢাকায় যাতায়াত করতে চান না। তারা বিমানে চলতে চান।
বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে বগুড়ার চারতারকা হোটেল নাজ গার্ডেনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোকরানা বলেন, বগুড়া উত্তরাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র। এখানে বিমানবন্দর না থাকায় ইতোমধ্যে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন চট্টগ্রামে চলে গেছে। বগুড়ার সঙ্গে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব নাজুক। এছাড়া সহজ রেলপথও নেই। তাই ভৌগোলিক, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কারণে দ্রুত বিমানবন্দর চালু করা জরুরি।
পাঁচতারকা হোটেল মমইনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী হায়দার বলেন, এখানে বিমান চলছে না, এমনটি ভাবাই যায় না। জনগণের চাহিদার কথা বিবেচনায় এনে বিসিএল প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আমরা নিজস্ব হেলিকপ্টার চালু করেছি। ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছি।
বগুড়ায় হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ী ও পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৫ হাজার বিদেশি ও পর্যটক বগুড়ায় আসেন। বাংলার প্রাচীন রাজধানী মহাস্থানগড়সহ দর্শনীয় ও ধর্মীয় একাধিক ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। চেম্বারের তথ্য অনুযায়ী, এ জেলায় সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ছোট-বড় প্রায় ২০টি শিল্প-কারখানা রয়েছে। এসব শিল্প-কারখানার মধ্যে রয়েছে, ওষুধ খাতের প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস ও ওয়ান ফার্মাসিউটিক্যালস, খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সকম কনজ্যুমার প্রোডাক্ট, মোটরসাইকেল সংযোজন প্রতিষ্ঠান উত্তরা মোটরস, এবিসি টাইলস, পেপার ও পার্টিকেল বোর্ডের কারখানা। এ ছাড়া বগুড়ায় চার তারকা মানের হোটেল রয়েছে দুটি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাণিজ্যিকভাবে বিমানসেবা চালুর মতো সব ধরনের অনুকূল পরিবেশ বগুড়ায় বিদ্যমান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিমানবন্দর চালু হলে শিল্পনগরী খ্যাত বগুড়ায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। পাশাপাশি জনগণ স্বল্প সময়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত এবং উৎপাদিত পণ্য খুব সহজে পৌঁছে দিতে পারবে।
/এএন