কী হবে কুসিকের দুই কাউন্সিলরের
দুটি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্রে আসামি হিসেবে নাম এসেছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) দুই কাউন্সিলর আবুল হাসান ও আবদুস সাত্তারের। দুজনকেই দুই খুনের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এর মধ্যে ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল হাসানকে অভিযুক্ত করা হয়েছে যুবলীগ কর্মী জিল্লুর রহমান ওরফে জিলানী হত্যা মামলায় এবং ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুস সাত্তারকে অভিযুক্ত করা হয়েছে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন হত্যা মামলায়। এই দুই মামলায় অভিযুক্ত দুই কাউন্সিলর বিভিন্ন সময় কারাভোগ করে এখন জামিনে মুক্ত আছেন।
সম্প্রতি কাছাকাছি সময়ে নগরীর আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর দু’টি হত্যামামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে পিবিআই। পিবিআই জানায়, গ্রেপ্তার আসামিদের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, দীর্ঘ তদন্তের পর হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী এবং নেপথ্যে থাকা পরিকল্পনাকারী ও হত্যাকাণ্ডের সহযোগীদের চিহ্নিত করেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
দুই হত্যায় দুই কাউন্সিলরকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিলের পর এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে- কী হবে অভিযুক্ত দুই কাউন্সিলরের। তারা কি স্বপদে থাকবেন, নাকি বরখাস্ত হবেন?
এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আদালত যদি অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন কিংবা অভিযুক্ত কাউন্সিলররা গ্রেপ্তার হন- তাহলে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ তা অফিশিয়ালি পুলিশ এবং আদালতের মাধ্যমে জানবেন। পরে তা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জানানো হবে। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার বিভাগ জনপ্রতিনিধিদের প্রথমে সাময়িক অব্যাহতি দেয়। যতদিন মামলার নিষ্পত্তি হয়ে চূড়ান্ত আদেশ না আসবে ততদিন তারা সাময়িক অব্যাহতিতে থাকবেন। পরে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আর যদি তদন্তে তারা নির্দোষ প্রমাণিত হন- তাহলে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
দুই হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে দুই কাউন্সিলরের নাম অন্তর্ভুক্ত থাকার বিষয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তাদের নাম অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি জেনেছি। অফিসিয়ালি এখনো জানিনি। বিজ্ঞ আদালতে পুলিশ অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন, তা গ্রহণ করারও একটি ব্যাপার আছে। আদালত থেকে কোনো নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত এ নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন হত্যার অভিযোগপত্র সম্পর্কে পিবিআইয়ের কুমিল্লার পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, তাদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া এক আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। দীর্ঘ তদন্তের পর হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী এবং নেপথ্যে থাকা পরিকল্পনাকারী ও হত্যাকাণ্ডের সহযোগীদের তারা চিহ্নিত করে অভিযোগপত্র দিয়েছেন।
আর জিল্লুর রহমান জিলানী হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, আমরা প্রতিটি মামলার তদন্তই গুরুত্বসহকারে করি। জিল্লুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমাদের অনেক গভীরে গিয়ে তদন্ত করতে হয়েছে। দীর্ঘ চেষ্টা ও তদন্তের পর শেষ পর্যন্ত আমরা হত্যার নেপথ্যের কারণ ও জড়িতদের শনাক্ত করতে পেরেছি। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
২০২০ সালের ১১ নভেম্বর সকালে নগরীর চৌয়ারা এলাকায় যুবলীগকর্মী জিল্লুর রহমান চৌধুরীকে ওরফে জিলানীকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পরদিন তার ভাই ইমরান হোসেন চৌধুরী কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানায় ২৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ১০/১৫ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে থানা পুলিশ। ২০২১ সালের ২ ডিসেম্বর তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ঘটনার আগেরদিন রাতে কাউন্সিলর হাসানের বাড়িতে খুনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সেই বৈঠকে পরিকল্পনাকারী ছাড়া বাকি ৯ জনই উপস্থিত ছিলেন। নগরীর চৌয়ারা গরু বাজার নিয়ন্ত্রণ ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ছিল খুনের কারণ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক বিপুল চন্দ্র দেবনাথ জানান, মামলার এজাহার-বহির্ভূত আসামি আরমান হোসেনকে গত বছরের ১৩ সেপ্টম্বর কুমিল্লা নগরীর চৌয়ারা বাজার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন কুমিল্লার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন আরমান। খুনের সময় পাহারাদারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন আরমান। আর বাকিরা খুনে অংশ নেন। হাসানের বাড়িতে বৈঠক ও তার পরিকল্পনায় খুনের কথা আরমান জবানবন্দিতে বলেছেন। এ খুনের মামলায় অভিযোগপত্রে প্রায় সবাই গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে আছেন। কাউন্সিলর হাসানও প্রায় ৬ মাস কারাগারে ছিলেন। এরপর জামিনে মুক্তি পান। গত ৯ ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষর হওয়া অভিযোগপত্র এরই মধ্যে আদালতে দাখিল করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এর আগে ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর কুমিল্লা নগরীর ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের শামবক্সি (ভল্লবপুর) এলাকায় কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনকে মাথায় গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনার পরদিন নিহতের বড় ভাই মো. শাহাদাত হোসেন নয়ন বাদী হয়ে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এই মামলার অভিযোগপত্রে খুনের পরিকল্পনাকারী হিসেবে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আবদুস সাত্তারের কথা বলা হয়েছে। সাত্তার কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতির পদে রয়েছেন। এই মামলায় কাউন্সিলর সাত্তারসহ মোট ১৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
দেলোয়ার হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক এম এ মঞ্জুর জানান, আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত কাউন্সিলর সাত্তারসহ ছয়জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর মধ্যে প্রধান আসামি রেজাউল ছাড়া বাকিরা জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। গত ২৩ জানুয়ারি স্বাক্ষর হওয়া অভিযোগপত্র এরই মধ্যে আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। এলাকায় প্রভাব বিস্তার, কাউন্সিলর নির্বাচনসহ রাজনৈতিক বিরোধে দেলোয়ারকে খুনের পরিকল্পনা করেন কাউন্সিলর সাত্তার।
এদিকে আলোচিত দুই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত দুই কাউন্সিলর আবুল হাসান ও আবদুস সাত্তার।
দেলোয়ার হত্যায় অভিযুক্ত নগরীর ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুস সাত্তার গণমাধ্যমকে বলেন, মামলার এজাহারে আমার নাম ছিল না। দেলোয়ার ভাইয়ের কাছ থেকে আমি রাজনীতি শিখেছি। আমাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এই মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। আদালতে আমি ন্যায় বিচার পেয়ে নির্দোষ প্রমাণিত হব।
অপর হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল হাসান বলেন, আমাকে চক্রান্ত করে ফাঁসানো হয়েছে। তিনি (জিল্লুর) সম্পর্কে আমার মামা। আমি কেন তাকে খুনের পরিকল্পনা করব? এগুলো পুরোপুরি ষড়যন্ত্র। জিল্লুর আর আমার ওয়ার্ড আলাদা। আমার সঙ্গে জিল্লুরের এমন কোনো বিরোধ ছিলো না যে তাকে খুন করতে হবে।
এ ব্যাপাারে যোগাযোগ করা হলে কুমিল্লা বারের আইনজীবী এএমএম মঈন বলেন, বিজ্ঞ বিচারক অভিযোগপত্র গ্রহণ করলে মামলা ট্রায়ালে যাবে। এরপরই বিচার কার্য শুরু হবে। অভিযোগ গঠন হলে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে। এসময় কেউ জামিনে থাকলে তারা নিয়ম মতো হাজির হবেন। পলাতক আসামি ওয়ারেন্টভুক্ত হলে পুলিশ তাদের যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করতে পারেন।
এসএন