‘অভিভাবকহীন’ চরকাউয়া খেয়াঘাট, ক্ষমতাধরদের পোয়াবারো
ইজারামুক্ত খেয়াঘাটে সমিতির নামে চলছে স্বেচ্ছাচারিতা ও বেআইনি অর্থ আদায়। দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সাধারণ মানুষ। ফায়দা লুটছে স্থানীয় ক্ষমতাধররা।
বরিশাল নগরীর মধ্যে ব্যস্তমত খেয়াঘাটগুলোর একটি চরকাউয়া খেয়াঘাট। এ স্থান থেকে ইঞ্জিনচালিত যাত্রীবোঝাই ট্রলারে প্রতিদিন নদী পাড়ি দিচ্ছেন (পূর্বপাড়) বরিশাল সদর উপজেলার চরকাউয়ার অর্ধলাখ মানুষ। যাত্রীদের সুবিধার জন্য সাবেক সিটি মেয়র প্রয়াত শওকত হোসেন হিরণ ঘাটটি ইজারামুক্ত ঘোষণা করে যান। বর্তমানে খেয়াঘাটটি কেউ আর তদারকি করছে না। এটি এখন অভিভাবকহীন। খেয়াঘাটের দুই পাড়ে নেই কোনো রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা এবং খেয়াঘাটের দুই পাড় ভাঙন রোধে ও জনদুর্ভোগ কমিয়ে আনতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দরকার বলে মন্তব্য করেন এলাকাবাসী।
যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং মোটরসাইকেল চালকদের জিম্মি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বরিশাল নগরীর বেলতলা খেয়াঘাটের চেয়ে চরকাউয়া খেয়াঘাটের দূরত্ব কম। তারপরও সেখানকার যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। চরকাউয়া খেয়াঘাটে মোটরসাইকেল পারাপারে ৫০ টাকা ভাড়া আদায় করা হয়। বেলতলা খেয়াঘাটের নদী পারাপারে দূরত্ব তুলনামূলক বেশি। সেখানে যাত্রীসহ একটি মোটরসাইকেল ২৫ টাকায় পারাপার করতে দেখা যায়।
চরকাউয়া খেয়াঘাটে ট্রলার মালিকরা যাত্রীদের জিম্মি এবং জোর-জুলুম করে এ ঘাটটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। এ ছাড়া ট্রলারে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে নদী পারাপারেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
চরকাউয়া খেয়াঘাট দিয়ে পারাপার হওয়া যাত্রী শফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ‘এই খেয়াঘাটে ইজারাদার না থাকায় নাগরিক সুবিধার বিন্দুমাত্র ছোঁয়া নেই। ২ টাকার ট্রলার ভাড়া এখানে ৫ টাকা করে দিতে হয়। এখান থেকে বরিশাল সদর উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের মানুষ চলাফেরা করে। এ ইউনিয়নগুলোর সীমানাঘেঁষা আরও ৭টি ইউনিয়ন আছে, যেগুলো বাকেরগঞ্জ উপজেলাভুক্ত। খেয়াঘাটের চরকাউয়া প্রান্তে বাসস্ট্যান্ড থেকে ভোলাসহ ৭টি রুটে বাস চলাচল করে। এসব কারণে এ খেয়াঘাটে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা যাত্রী পারাপার হয়। এই খেয়া পারাপারে আমরা অনেক জোর-জুলুমের শিকার হই। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়।’
ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন ফয়সাল নামে একজন খেয়াযাত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি এখান দিয়ে প্রতিদিন যাওয়া-আসা করি। সবাই যেমন টাকা দেয়, আমিও তেমন দেই। কার সঙ্গে ঝামেলা করবো? আমাদের এখান থেকে খেয়া পার হতে হবে। তাই ভাড়া বেশি বা কম নিলে আমাদের কিছুই করার থাকে না। আমরা সারাজীবন ধরে এ অবহেলার শিকার হয়ে আসছি।’
খেয়া দিয়ে পার হওয়া নিয়মিত যাত্রী শহীদ বলেন, ‘প্রতিদিন এখান থেকে আমার মোটরসাইকেল পারাপার করতে হয়। তবে মোটরসাইকেল পারাপারে আদায় করা ভাড়াটি অতিরিক্ত। এ পাড় থেকে ওই পাড়ে যেতে সময় লাগে মাত্র ২ মিনিট। দূরত্ব খুব অল্প। কিন্তু তারা একটি মোটরসাইকেল পারাপার করতে ৫০ টাকা ভাড়া আদায় করে।’
এই ঘাটের মোটরসাইকেল নিয়ে পার হওয়া যাত্রী সৌরভ বলেন, ‘আমাদের নগরীর সাবেক সিটি মেয়র প্রয়াত শওকত হোসেন হিরণ ঘাটটি ইজারামুক্ত ঘোষণা করেছিলো যাত্রীদের ভালোর জন্য। কিন্তু আজ সেটা আমাদের দুর্ভোগের কারণ হয়েছে। একটা মোটরসাইকেল পারাপারে ৫০ টাকা করে দিতে হয়। যা অনেক বেশি। এ ছাড়া ঘাটের দুই পাড় ভাঙা, তাই আমাদের চলাচলও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে।’
এ বিষয়ে ট্রলারচালক জুম্মান বলেন, ‘আমি এখানে ভাড়ায় ট্রলার চালাই। প্রতিদিন ৪০০ টাকা করে ভাড়া দিতে হয়। আয়ের বাকি টাকা আমার থাকে।’
তিনি বলেন, ‘মালিক সমিতি যত টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়, আমরা যাত্রীদের কাছে থেকে সেটাই তুলি। প্রতিটি ট্রলারে ২০ জন যাত্রী তোলা হয়। প্রতিদিন আমাদের কমপক্ষে ২ হাজার টাকা ইনকাম হয়। তবে ট্রলার মালিক সমিতির কাছে প্রতিদিন আরও ২০ টাকা করে দিতে হয়। ওই ২০ টাকার ১০ টাকা ঘাটের রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ব্যবহার করা হয়। বাকি ১০ টাকা আমাদের ৩ বছর পর ফেরত দেওয়া হয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ট্রলারচালক বলেন, ‘আমরা ট্রলার মালিকদের ৪০০ টাকা জমা দেই ভাড়া হিসেবে। কিন্তু এর বাইরেও আমাদের প্রতিদিন ২০ টাকা করে সমিতির কাছে জমা দিতে হয়। এই টাকার হিসাব আমরা পাই না।’
ট্রলার চালকদের কাছ থেকে প্রতিদিন ‘সঞ্চয়’ নামে অতিরিক্ত ২০ টাকা করে কেন নেওয়া হয়, সে প্রশ্নের উত্তরে চরকাউয়া ট্রলার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাত বলেন, ‘এই ঘাটে প্রতিদিন ৬৫টি ট্রলার চলাচল করে। এই ট্রলার চালকদের কাছে প্রতিদিন যে ২০ টাকা করে নেওয়া হয়, সে টাকার ২টি ভাগ হয়। ওই টাকার ১০টাকা হিসেবে তিনবছর পর প্রত্যেক মালিক নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। বাকি ১০ টাকা ঘাটে ট্রলার বাঁধার জন্য এবং সমিতির আনুষঙ্গিক খরচে ব্যবহার করা হয়।’
খেয়ায় অতিরিক্ত যাত্রী তোলার কথা অস্বীকার করে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা খেয়ায় ২০ জনের বেশি যাত্রী তুলি না। কোনো চালক অতিরিক্ত যাত্রী তুললে তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেবো। তবে বর্তমানে আমাদের খেয়া ঘাটের দুই পাড়ে যে ভাঙা আছে, সে সমস্যার সমাধান শিগগিরই হবে। ইতোমধ্যে টেন্ডার পাস হয়েছে।’
তবে কাজ আদৌ কবে শুরু হবে সে সম্পর্কে কোনো জবাব দেননি তিনি। খেয়ায় যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্তি ভাড়া আদায় কেন করা হয় এ প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তরও দিতে পারেননি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক।
এদিকে, চরকাউয়া ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি ওমর আলিকে ফোনকলে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
নগরীর বেলতলা খেয়াঘাটের ইজারাদার মোকলেস বলেন, ‘চরকাউয়া খেয়াঘাট ইজারামুক্ত করার পর শুধু যাত্রীদের ওপর নয়, খেয়া চালকদের ওপরেও জোর-জুলুম করা হয়। ট্রলার মালিক সমিতির সঙ্গে যুক্ত না হলে ওই ঘাটে কেউ ট্রলার চালাতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বেলতলা খেয়াঘাটের চলতি ডাক ৬৪ লাখ টাকার, তবু আমরা এই ঘাটে নদীর দূরত্বের তুলনায় খুব কম ভাড়ায় যাত্রী টানি। সেখানে হিসাব করলে চরকাউয়া খেয়ায় যাত্রীদের ওপর অনেক জোর-জুলুম করা হয়।’
সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি শাহ্ সাজেদা বলেন, ‘জনগণ ও খেয়া চালকদের জন্য এই ঘাটটি ইজারামুক্ত করে দিয়েছিলেন সাবেক সিটি মেয়র প্রয়াত শওকত হোসেন হিরণ। তবে ক্ষমতাবানরা এ ঘাটটি জিম্মি করে রেখেছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ফলে জনগণের ন্যায্য অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। খেয়াঘাটিকে দ্রুত যথাযথ কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা জরুরি।’
এসও/এসপি/এএন