সেন্টমার্টিন দ্বীপে স্থাপনা নির্মাণে মানা হচ্ছে না নিয়ম

অনিয়ন্ত্রিত পর্যটক, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ ও নানা কারণে দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। গত কয়েক দশকে এ দ্বীপের যে ক্ষতি হয়েছে, তা নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও দ্বীপটি রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক সময়ের বিধিনিষেধ মানা হচ্ছে না। সেন্টমার্টিনে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ দিন দিন বেড়ে চলেছে।
সেন্টমার্টিনে ইকো সিস্টেমে স্থাপনা নির্মাণ করার কথা থাকলেও বাস্তবে সেটা করা হচ্ছে না। রড, সিমেন্ট, পাথর ও ইট দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্টে ও দালান। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী পাঁচ বছর পর সেন্টমার্টিন দ্বীপের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বিলুপ্ত হয়ে যাবে সেন্টমার্টিন দ্বীপ।
সম্প্রতি সংসদীয় কমিটির সভাপতি র আ ম উবাইদুল মোক্তাদির চৌধুরী বলেন, সেন্টমার্টিন হুমকির মুখে চলে যাচ্ছে দিন দিন। সেখানে নির্মিত হচ্ছে বড় বড় বাণিজ্যিক দালান, যা সেন্টমার্টিনের পরিবেশের সঙ্গে কোনোভাবে মিলছে না। এভাবে চলতে থাকলে আগামী পাঁচ বছরে সেন্টমার্টিন বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। সেন্টমার্টিন দ্বীপকে একটি পরিকল্পিত এবং পরিবেশবান্ধব পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে কাজ করার জন্য সংসদীয় কমিটি সরকারকে অনুরোধ জানাবে।
র আ ম উবাইদুল মোক্তাদির চৌধুরী বলেন, ২৫ বছর আগে সেন্টমার্টিন দ্বীপের অবস্থা এ রকম ছিল না। তখন অনেক গোছানো ছিল। আগামী দিনের সেন্টমার্টিন দ্বীপ গড়ে তুলতে হবে প্রকৃতির সমন্বয়ে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে।
গত শনিবার কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রথমবারের মতো বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পরে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান সংসদীয় কমিটির সভাপতি র আ ম উবাইদুল মোক্তাদির চৌধুরী।
কক্সবাজারের পরিবেশবাদী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, ২০২০ সালে এনভায়রনমেন্ট পিপল সেন্টমার্টিন দ্বীপে একটি জরিপ করেছিল, সেই সময় দ্বীপটিতে ছোট-বড় ১২৩টি আবাসিক হোটেল ও কটেজ ছিল। এর মধ্যে আড়াই ডজনের বেশি ছিল দুই ও তিনতলা পাকা ভবন। জরিপের তিন বছরের মধ্যে সেই সংখ্যা দেড় গুণের বেশি বেড়েছে। তা ছাড়া নতুন আরও ১৮টি স্থাপনার কাজ চলছে। এজন্য প্রশাসনের অবহেলাকেই দায়ী করছেন পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনকারীরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, যত্রতত্র গড়ে উঠছে ইট ও কংক্রিটের স্থাপনা। আর সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমানের সিন্ডিকেট এসব স্থাপনার নির্মাণসামগ্রী আনছে বলে অভিযোগ রয়েছে। চেয়ারম্যানের ভাগনে হেলাল মিয়াও একটি স্থাপনা নির্মাণ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এনভায়রনমেন্ট পিপলের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে প্রশাসন আন্তরিক নয়। প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যেই টেকনাফ থেকে নির্মাণসামগ্রী এনে এসব অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করছে। মাঝেমধ্যে প্রশাসনের লোকজন এসব স্থাপনা বন্ধে মৌখিক নির্দেশ দিয়ে আসেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। প্রশাসন আজ পর্যন্ত একটি স্থাপনার কাজও বন্ধ রাখতে পারেনি।
সেন্টমার্টিনকে গত বছর মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া ঘোষণা করে সরকার। ঘোষণা অনুযায়ী এখানে ইট-সিমেন্ট আনা নিষিদ্ধ। শুধু বাঁশ-কাঠ দিয়ে ইকো-ফ্রেন্ডলি রিসোর্ট-রেস্তোরাঁ বানানো যাবে। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ড্রিমার্স প্যারাডাইস বিচ রিসোর্ট, আটলান্টিক রিসোর্টসহ সাইনবোর্ডবিহীন ১৮টির বেশি স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলতে দেখা গেছে। নিমার্ণ শ্রমিকরা এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এমনকি মালিকের নাম বলতেও রাজি হননি কোনো শ্রমিক।
সেন্টমার্টিনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান জানান, কোনোভাবেই আমি দালান নির্মাণের সঙ্গে জড়িত না। সেন্টমার্টিনে ইট, সিমেন্ট দিয়ে পোস্ট অফিস, কোস্টগার্ড কার্যালয় ও লাইট হাউস নির্মাণ করা হচ্ছে। বাকি সব ইকো সিস্টেমে করা হচ্ছে।
চেয়ারম্যানের ভাগনে হেলালের তিনতলা রিসোর্ট নির্মাণ প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান মুজিব বলেন, আমার আত্মীয়স্বজন কেউ ভবন বানালে সেটি আমার ব্যাপার নয়। এর দায় আমার হওয়ার কথা নয়।
সেন্টমার্টিন পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আজহারুল ইসলাম বলেন, দ্বীপে অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে আমার করার কিছুই নেই। আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এলে অভিযান হয়। কার্যালয়ে আমি একা থাকি। প্রশাসনিক শক্তিও নেই যে কাজ বন্ধ করে দেব। ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ ছাড়া আর কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। কংক্রিট স্থাপনা বাঁশ ও পাতা দিয়ে ঢেকে এখানে নাম দেওয়া হয় ইকো রিসোর্ট।
টেকনাফের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. এরফানুল হক চৌধুরী বলেন, দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করছি আমরা। স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান চলছে। সরকারের নির্দেশনা মানতে যা করণীয় সবই করা হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করেন। তাদের কেন্দ্র করে দ্বীপের চারপাশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে স্থাপনা তৈরির হিড়িক পড়েছে। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, সেহেতু সেন্টমার্টিন দ্বীপ একসময় সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় পর্যটক ও স্থানীয়রা সচেতনতার পরিচয় না দিলে দ্বীপটি আরও দ্রুত হারিয়ে যাবে।
এসএন
