দেলোয়ারের বাগান সেজেছে ১০ রঙের টিউলিপে
গাজীপুরের শ্রীপুরের কেওয়া পূর্ব খন্ড গ্রামের একজন সফল উদ্যোক্তা হলেন দেলোয়ার হোসেন। এই বছর তার বাগানজুড়ে ফুটেছে সারি সারি ১০ রঙের টিউলিপ। বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হচ্ছে এসব টিউলিপ ফুলের চারা। টপের রাখা ৪টি চারা বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে টিউলিপ ফুলের চারা কিনতে ‘মৌমিতা ফ্লাওয়ার্স’ প্রোডাক্টস নামের এই টিউলিপ বাগানে আসছেন দর্শনার্থীরা।
টিউলিপ সাধারণত শীতপ্রধান দেশের ফুল। এর উৎপত্তিস্থল নেদারল্যান্ডস। অটোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকে এই ফুলের পরিচিতি রয়েছে। অনেকের মতে, এটি পামির মালভূমি এবং হিন্দুকুশ পর্বতমালা অঞ্চল থেকে উদ্ভুত হয়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে এর দেখা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর এই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন উপজেলার কেওয়া পূর্বখণ্ড গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা দেলোয়ার।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, দেলোয়ারের বাগানজুড়ে নানান রঙের শত শত টিউলিপ ফুল ফুটে রয়েছে। বেগুনি, হলুদ, লাল ও সাদাসহ মোট ১০ রঙের টিউলিপ ফুল রয়েছে এই বাগানে। তাইতো দৃষ্টি কাড়ে হাজারো দর্শনার্থীদের।
জানা গেছে, ডিসেম্বর মাসের শুরুতে প্লান্টিং শুরু হয়। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শত শত টিউলিপ ফুলে ভরে যায় তার বাগান। এ জন্য শীত এলেই বিদেশি এই ফুল দেখতে তার বাগানে ভিড় জমায় দর্শনার্থীরা।
শনিবার দুপুরে কথা হয় ঢাকার ধানমন্ডি থেকে আসা বিজিএমএ কলেজের ছাত্রী ফাতেমা আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, আজকে ছুটির দিন, তাই দেলোয়ারের মৌমিতা ফ্লাওয়ার্স প্রোডাক্টসের বাগানে বিভিন্ন বাহারি রঙের টিউলিপ ফুল দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি।
ওই শিক্ষার্থী আরো জানায় ,বাংলাদেশের মাটিতে বিদেশি টিউলিপ ফুল চাষী সফল উদ্যোক্তা দেলোয়ার ভাইকে ধন্যবাদ জানাই এত সুন্দর একটি বাগান করায়।
এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পর্যটক, সাধারণ দর্শনার্থী থেকে শুরু করে তার এ বাগানে আসেন কৃষক ও কৃষি শিল্প উদ্যোক্তারাও।
এ বিষয়ে বাগান মালিক দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ফুলের বাগানসহ নার্সারি কাজে সম্পৃক্ত তিনি। ২০১৮ সালে রিচ ওয়ান নামের একটি সিড কোম্পানি টিউলিপ ফুলের এক হাজার বাল্ব (কন্দ) তাকে উপহার দিতে চান। কিন্তু প্রস্তুতি না থাকায় আনেননি। পরের বছর আনেন তিনি। রোপনের ২৫ দিন পর প্রথম একটি টকটকে লাল রঙের ফুল ফুটে। এরপর থেকেই বড় করে এই ফুলের চাষ শুরু করেন। বিশেষ করে গত বছর বড় পরিসরে চাষ করতে সক্ষম হন তিনি।
দেলোয়ার জানান, চারদিকে পলিথিন এবং বিশেষ কাগজ দিয়ে বড় ধরনের ঢাকা শেড তৈরি করেছেন। যার চারপাশে ছিদ্রযুক্ত নেট ব্যবহার করেছেন। এতে বিশেষ পদ্ধতিতে সূর্যের আলো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা করে। প্রতিটি ফুলে তাঁর ৬৫ টাকা খরচ হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, পর্যটকদের কাছে প্রতিটি চারা ১০০ টাকা করে বিক্রি করেন। সম্প্রতি নেদারল্যান্ডস থেকে তিনি ১ হাজার ১০০টি টিউলিপ গাছের বাল্ব (বীজ হিসেবে ব্যবহৃত রূপান্তরিত কাণ্ড) নিয়ে আসেন। সেগুলোকে রোপন করে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখেন। নিয়মিত পরিচর্যা আর প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে প্রথমবারেই পেয়ে যান সফলতা।
টিউলিপের চাষ নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথা শোনান দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোথাও টিউলিপের চাষ হচ্ছে না। তাই এই ফুলকে তিনি দেশে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে দিতে কাজ শুরু করেছেন। এই বছর নেদারল্যান্ড থেকে হলুদ, লাল, পিংক, অরেঞ্জ, সাদা, পার্পেলসহ ৮/১০ প্রজাতির ৭০ হাজার টিউলিপের বীজ আমদানি করেছেন। আমদানি করা বিজের ৪০ হাজার পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়, ১ হাজার রাজশাহীতে এবং ৫ হাজার যশোরের গদখালীতে রোপন করেছেন।
এই কৃষি উদ্যোক্তা বলেন, এই দেশে গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাসসহ বিভিন্ন ফুল ব্যাপকভাবে চাষ হয়। তবে ভিন্ন সৌন্দর্যের টিউলিপ ফুলের ব্যাপক চাহিদা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশের ফুলের বাজারে গোলাপসহ অন্যান্য ফুলের ভিড়ে ব্যাপকভাবে টিউলিপ ছড়িয়ে দিতে চান তিনি। তার বিশ্বাস, এই দেশে টিউলিপের বড় বাজার তৈরি করা সম্ভব। বড় পরিসরে উৎপাদনে যাওয়াও সম্ভব।
তিনি আরো বলেন, এখনো বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ ফুল বিক্রি করে লাভবান হতে পারেননি। তবে স্বপ্ন দেখেন, একদিন নিজের আর্থিক চাহিদা পূরণ করেও দেশের জিডিপি বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবেন।
দেলোয়ার বলেন, আমাদের দেশে ফুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সেই চাহিদা মেটাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ফুল আমদানি করা হয়। ফুল চাষে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ’ হয়ে উঠলেও আমরা পিছিয়ে আছি। দেশের অর্থনীতি ও চাহিদার কথা চিন্তা করে বিভিন্ন বিদেশি ফুল দিয়ে আমার স্বপ্ন যাত্রা শুরু। নানা প্রতিবন্ধকতার পরও থেমে থাকিনি। এরই মধ্যে পেয়ে যাই একের পর এক সফলতা। গত বছর টিউলিপ ফুল ফুটিয়ে নতুন স্বপ্ন ছুঁতে পেরেছি।
এর আগে জার্বেরা, চায়না গোলাপ ও বিদেশি বিভিন্ন ফুল চাষে সফল হয়েছেন তিনি। স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৭ সালে পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু কৃষি পদকও ।
এসআইএইচ