রশি টানা নৌকায় নদী পারাপারে ৫০ বছর!
'সরকার যায়, সরকার আসে, এমপি যায়, মন্ত্রী আসে, কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের ইছামতী নদীর উপর একটি সেতু হয় না। ঘোচে না আমাদের দুর্ভাগ, দুঃখ দুর্দশা। অথচ নির্বাচনের সময় সব দলের প্রার্থীরা ইছামতী নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিলেও আজও কেউ কথা রাখেনি'। ক্ষোভের সঙ্গে কথা গুলো বলছিলেন রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১নং রাজানগর ইউনিয়নের শিয়ালবুক্ক এলাকার বাসিন্দা আবুল বশর।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১নং রাজানগর ও দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতী নদীর উপর স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছর পরেও একটি সেতু নির্মিত না হওয়ায় যুগ যুগ ধরে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন দুই ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার মানুষ। বিশেষ করে একটি সেতুর অভাবে উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত রাজানগর ইউনিয়নের শিয়ালবুক্ক এলাকার নদীবেষ্টিত ৩ গ্রামের ১০ হাজার মানুষ। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছর পরেও একটি সেতু নির্মিত না হওয়ায় এই ৩ গ্রামে পড়েনি তেমন একটা উন্নয়নের প্রভাব।
দীর্ঘদিনের দাবীর পরও ইছামতির নদীর ওপর সেতু না হওয়ায় দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে রশি টানা নৌকা দিয়ে নদী পার হতে হয় উপজেলা রাজানগর ও দঃ রাজানগর ইউনিয়নের বড়ুয়াপাড়া, হরিণাছড়া, শিয়ালবুক্ক ও ফুলবাগিচাসহ আশেপাশের আরও ৮ গ্রামের ২০ হাজার মানুষকে। চরম দুর্ভাগ ও ঝুঁকি নিয়ে নদী পারাপার করলেও এসব মানুষের কষ্ট যেনো দেখার কেউ নেই।
জানা যায়, চট্টগ্রাম - কাপ্তাই সড়ক ও চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের সংযোগ সড়ক হচ্ছে পারুয়া-রানীরহাট কালীন্দা রাণী সড়ক। উপজেলা ও জেলা শহরে যাতায়েতের একমাত্র পথ হচ্ছে এই সড়ক।
এই কালীন্দা রাণী সড়কটি বয়ে গেছে রাজানগর ও দঃ রাজানগর ইউনিয়নের উপর দিয়ে। আর উক্ত ইউনিয়ন দু'টির উপর দিয়ে প্রবাহিত ইছামতী নদী। নদীর পশ্চিম পাশে রয়েছে ৩টি গ্রাম, পূর্ব পাশে রয়েছে ৫টি গ্রাম। পশ্চিম পাশের ৩ গ্রামের তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে ইছামতী নদী। অনেকটা দ্বীপের মতো।
এই গ্রামের হাই স্কুল, প্রাইমারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় পড়ুয়া প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন রশি টানা নৌকা দিয়ে ইছামতী নদী পার হয়ে রাজাভূবন স্কুল, খন্ডলিয়া পাড়া মাদ্রাসা, আলমশাহ পাড়া কামিল মাদ্রাসা, উত্তর রাঙ্গুনিয়া হাই স্কুল, উত্তর রাঙ্গুনিয়া ডিগ্রি কলেজ, রাণীরহাট কলেজে যাতায়াত করেন।
এছাড়াও প্রতিদিন এপাশ ওপাশের মানুষজন নিত্য কাজে শিয়ালবুক্ক ঘাট দিয়ে এই নদী পারাপার হন। একই সাথে জেলা ও উপজেলা সদরে বিভিন্ন কাজসহ কৃষিকাজে আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে চাষাবাদ করা, অফিস-আদালত, হাট-বাজার, অসুস্থদের চিকিৎসাসেবা নিতে যাতায়াত করে এখানকার হাজার হাজার মানুষ। সেতু না থাকায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় পশ্চিম পাড়ের ৩ গ্রামের মানুষদের। বেশী ভোগান্তিতে পড়তে হয় শিশু-নারী ও বৃদ্ধদের। ঘাটে এসে তাদের অপেক্ষা করতে হয় পুরুষদের জন্য। এরপর রশি টেনে নৌকা নিয়ে নদী পার হতে হয়।
বর্ষাকালে এ ভোগান্তি, দুর্দশা তীব্র আকার ধারণ করে। শুধু তাই নয় বর্ষা মৌসুমে এই নদী পার হওয়া অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। নদী পার হতে গিয়ে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকারও হতে হয় এসব গ্রামবাসীদেরকে। প্রায়শ নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটে বলে জানান এলাকাবাসী।
এদিকে একটি সেতুর অভাবে নদীর পশ্চিম পাড়ের ৩ গ্রামে অগ্নিকাণ্ড, অসুস্থ রোগীদের নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া বা কোনো প্রকার দুর্ঘটনা ঘটলে পুলিশ প্রশাসনের সদস্যরাও দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেনা।
এলাকাবাসীর অভিযোগ দল পাল্টায়, সরকার যায়, সরকার আসে, এমপি যায় মন্ত্রী আসে। কিন্তু ইছামতী নদীর উপর একটা সেতু হয় না। অথচ ভোট এলে সব দলের নেতারাই সেতু নির্মাণের কথা দেন, কিন্তু কথা দিয়েও কেউ কথা রাখেননি। ইছামতী নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণ এখন এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি।
রোকসানা আক্তার নামে রাজভূবন উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর এক ছাত্রী জানান, আমাদেরকে প্রতিদিনই রশি টেনে নৌকা নিয়ে নদী পার হয়ে স্কুলে যেতে হয়। অনেক সময় নৌকা না পেলে স্কুলে পৌঁছাতে দেরি হয়। আর শুষ্ক মৌসুমে হাঁটু পানি পার হতে হয়। বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি বৃদ্ধি পেলেই যাতায়াতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। একটা সেতু হলে আমাদের এই কষ্ট দূর হত।
শিয়ালবুক্ক এলাকার বয়োবৃদ্ধ সুলতান আহমদ বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ৫০ বছরে কত সরকার এলো গেলো, কত এমপি গেলো মন্ত্রী এলো আমাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হলো না। অথচ ভোট এলে সব দলের প্রার্থীরা ইছামতী নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু আজও কেউ কথা রাখেনি। দ্রুত ইছামতী নদীতে একটি সেতু নির্মাণের জন্য আমরা সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাই।
রাজানগর ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আ. লীগের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জি: শামসুল আলম বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে মাননীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এ পর্যন্ত রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ছোট-বড় প্রায় অর্ধশতাধিক সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। তারপরও যদি কোনো নদীতে সেতু না থাকে সেখানে পর্যায়ক্রমে সেতু নির্মাণ করা হবে। ইছামতী নদীর ওইস্থানে সেতু স্থাপনের বিষয়ে আগামী উপজেলা পরিষদের মাসিক সভায় দাবি জানানো হবে।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা প্রকৌশলী দিদারুল আলম বলেন, যেসব নদীতে সেতু নির্মাণ প্রয়োজন এমন তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তারপরও আমি উক্ত স্থান পরিদর্শন করে প্রয়োজনবোধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রস্তাব পাঠাবো, যাতে অতি দ্রুত শিয়ালবুক্ক এলাকার ইছামতী নদীতে একটি সেতু নির্মাণ করা হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আতাউল গণি ওসমানী বলেন, রাজানগর ইউনিয়নের শিয়ালবুক্ক নামকস্থানে একটি সেতু স্থাপনে এলাকাবাসীর দাবির বিষয়টি জানতে পারলাম। এলজিইডি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে দ্রুত পর্যবেক্ষণ করা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বিষয়টি জানানো হবে।
এএজেড