কেমিক্যাল আমদানিতে ‘ফ্ল্যাট রেট’ চায় চামড়া ব্যবসায়ীরা
দেশের চামড়া শিল্পের অগ্রগতি ও বন্ড ও নন-বন্ডেড ট্যানারির মধ্যে সমতা আনতে চামড়া শিল্পের অন্যতম প্রধান কাঁচামাল তথা কেমিক্যাল আমদানিতে আমদানি শুল্ক নির্দিষ্ট করে একটি ফ্ল্যাট রেট নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন ট্যানারি মালিকরা।
তারা বলছেন, বর্তমানে শিল্প নগরীর ১৪১টি সচল ট্যানারির বিপরীতে বন্ড সুবিধা রয়েছে এমন ট্যানারির সংখ্যা মাত্র ২৭টি। রপ্তানিমুখী হলেও বাকিদের বাণিজ্যিক লাইসেন্স ব্যবহার করে উচ্চহারে শুল্ক দিয়ে কেমিক্যাল আমদানি করতে হচ্ছে, ফলশ্রুতিতে চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট আর প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছে তাদের।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে এই শিল্পে বন্ড সুবিধা নেই এমন ট্যানারি মালিকদের কেমিক্যাল আমদানির ক্ষেত্রে কেমিক্যাল ভেদে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও অন্যান্য চার্জসহ টোটাল ট্যাক্স ইনসিডেন্স (টিটিআই) ৩৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত পড়ে যায়। বিপরীতে বন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত ট্যানারিগুলো একই কেমিক্যাল সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করতে পারছে। যার কারণে একই ধরনের চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে বন্ড ও নন বন্ডেড ট্যানারির উৎপাদন খরচও ভিন্ন হচ্ছে, ক্ষেত্রবিশেষে বন্ডেড ট্যানারির তুলনায় নন-বন্ডেড ট্যানারির খরচও বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণ।
একাধিক ট্যানারি মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে ট্যানারি স্থানান্তরের পর শিল্প নগরীতে প্লট বরাদ্ধ দেওয়া ১৬২টি ট্যানারিকে। যার মধ্যে বর্তমানে সচল ট্যানারির সংখ্যা ১৪১টি। এর মধ্যে মাত্র ২৭টি ট্যানারি কারখানার বন্ড সুবিধা রয়েছে।
এ ছাড়া এই খাতে ট্যানারি নেই কিন্তু বিভিন্ন ট্যানারি কারখানায় জব ওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করিয়ে দেশের বাইরে চামড়া রপ্তানি করছে এমন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও একেবারেই কম নয়।
সদর ট্যানারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ চৌধুরী জানান, ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন দেশে প্রায় ৪৪ লাখ ডলারের চামড়া রপ্তানি করেছে। বিপরীতে কেমিক্যাল আমদানি করেছে ৫ থেকে ৬ লাখ ডলারের।
তিনি জানান, এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় এখন পর্যন্ত ইউরোপের বাজারে প্রবেশাধিকার পায়নি বাংলাদেশের ট্যানারিগুলো। এ কারণে চীন, ভিয়েতনাম, জাপান, তুর্কির বাজারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছে তাদের, পাচ্ছেনও কম মূল্য।
তিনি আরও জানান, এই প্রতিযোগিতার বাজারে নিজের শিল্প লাইসেন্সের বিপরীতে যে ৫ লাখ ডলারের ক্যামিকেল তিনি আমদানি করেছেন, এর মধ্যে শুল্ক-ভ্যাটসহ অন্যান্য আমদানি খরচ রয়েছে ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে বন্ডেড ট্যানরিগুলো এই ক্যামিকেল শুল্কমুক্ত সুবিধায় অন্তত ৪০ শতাংশ কম খরচে আমদানি করছে। ফলে প্রতিযোগিতার এই বাজারে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে গড়ে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। আর এমন পরিস্থিতিতে বাজারে টিকে থাকাই তাদের জন্য মুশকিল হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমরা এর আগে চামড়া শিল্পের জন্য বেসিক (অধিক ব্যবহৃত কেমিক্যাল) যে ২০-২২টি কেমিক্যাল রয়েছে সেগুলো আমদানিতে সব মিলিয়ে ২০ শতাংশ আমদানি শুল্ক নির্ধারণ করে একটি ফ্ল্যাট রেট নির্ধারণ করার জন্য এনবিআরের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। যদিও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। তবে আশা করছি আগামী বাজেটে বিষয়টি বিবেচিত হবে।
তিনি আরও বলেন, ফ্ল্যাট রেট করে দিলে আমদানিতে এই সুবিধাটি সবাই পাবে। এখন যেমন বন্ডেড ট্যানারি ব্যতীত বাকিদের অতিরিক্ত শুল্ক দিয়ে কেমিক্যাল আমদানি করতে হচ্ছে। এ কারণে তাদের উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফ্ল্যাট রেট হলে এই বৈষম্য আর থাকবে না, একটা সমতা চলে আসবে এই শিল্পে। চামড়া শিল্পও নতুন গতি পাবে।
বর্তমানে কেমিক্যাল আমদানিতে ভিন্ন ভিন্ন কেমিক্যালের জন্য এইচএস কোড অনুযায়ী ভিন্ন হারে শুল্ক ও আমদানি সংক্রান্ত অন্যান্য খরচ বহন করতে হয় আমদানিকারকদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ট্যানারি মালিক বলেন, বর্তমানে চামড়া শিল্পের যেই বেসিক কেমিক্যালগুলো রয়েছে, কেমিক্যাল ভেদে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট দিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ৩৫-৪০ শতাংশ পর্যন্ত উঠে যায়। অর্থাৎ আমার উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে ৩৫-৪০ শতাংশ। বাধ্য হয়ে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে অনেকেই হয়তো কেমিক্যাল আমদানিতে আন্ডার ইনভয়েস কিংবা বন্ডেড ট্যানারির সহায়তা নিয়ে কেমিক্যাল আমদানি করছে। ফলে যেটি হচ্ছে, সরকার একটি বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে।
তিনি বলেন, আবার যেসব কেমিক্যাল আমদানিতে আমদানি খরচ ৯০-১০০ শতাংশ পর্যন্ত পড়ে যায়, সেসব কেমিক্যাল আমরা নন-বন্ডেড ট্যানারি মালিকরা আমদানি করতে পারি না। এসব কেমিক্যাল আমদানি করতে পারলে আমরা বিশেষ কিছু মানের চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে পারতাম, আন্তর্জাতিক বাজারে যার মূল্য তুলনামূলক বেশি।
তিনি আরও বলেন, আমরা চাই যেহেতু এটি একটি রপ্তানিমুখী শিল্প এবং সবাই বন্ড সুবিধা পাচ্ছে না, আবার ইউরোপের বাজারও আমাদের জন্য এখনো উন্মুক্ত হয়নি, সুতরাং কেমিক্যাল আমদানিতে খরচ আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট মিলিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করে দেওয়া হোক। এটি হলে আন্ডার ইনভয়েসের ঘটনাও ঘটবে না, সরকারও রাজস্ব পাবে, বাজারেও সমতা থাকবে।
এসজি