ফসলি জমির মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়, কমেছে ৪০০ হেক্টর
কুমিল্লা জেলা জুড়ে অবাধে চলছে ফসলি জমির মাটি কাটার হিড়িক। ইটভাটা মালিকদের আর্থিক প্রলোভনে মাটি বিক্রির সর্বনাশা কাণ্ডে মেতেছে মুনাফা লোভী ভূমি মালিক ও কৃষক। এতে একদিকে ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে ফসলি জমি, অপরদিকে মাটির উর্বরতা কমে অনাবাদি হয়ে যাচ্ছে শতশত হেক্টর কৃষি জমি। আর এসব মাটি পরিবহনে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট। শুকনো মৌসুমে ধুলিবালিতে চলাচলের অনুপযোগি হয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।
সবশেষ জেলার মুরাদনগরে জমির কাটায় বাধা দেওয়ায় প্রাণ হারাতে হয়েছে এক ব্যক্তিকে। বুধবার (১৮ জানুয়ারি) রাতে উপজেলার নবীপুর ইউনিয়নের বকুলনগর গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে। নিহতের নাম আব্দুল বারেক ওরফে খোকন মিয়া (৬২)। তিনি বকুল নগর গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে। এর আগে জেলার লাকসামে ড্রেজার মেশিনে মাটি কাটা বন্ধ করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন ভূমি অফিসের কর্মকর্তাসহ তিনজন।
প্রশাসনের অভিযান, স্থানীয়দের বাধার পরও জেলাজুড়ে কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না ফসলি জমির মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা। জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, কুমিল্লা জেলায় এক লক্ষ ৯৫ হাজার হেক্টর আবাদি জমি ছিল। গত তিন বছরে ৪শ হেক্টর আবাদি জমি হ্রাস পেয়েছে! মূল কারণ হিসেবে ফসলি জমির টপ সয়েল কেটে নেওয়াকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিনে জেলার সদর উপজেলা, চান্দিনা, দেবীদ্বার, বুড়িচং, লালমাই, বরুড়া, চৌদ্দগ্রাম, মুরাদনগরসহ বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে বেশির ভাগ ফসলি জমির মাটি কেটে ওই মাটি স্থানীয় ইটভাটাগুলোর জোগান দিচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও ড্রেজিং করে ফসলী জমির মাটি দিয়ে বাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠা গড়তে ভরাটের কাজ চলছে।
স্থানীয় প্রশাসন মাঝে মধ্যে ২/৪টি অভিযান চলানোর ফলে কোথাও কয়েকদিন বন্ধ থাকে আবার কোথাও প্রশাসনের গাড়ি বহর চলে গেলে পুরানো চিত্রে ফিরে আসে ওই মাটি খেকো শ্রেণী পেশার মানুষ। আবার কোথাও কোথাও স্থানীয়দের রোষানলে পড়তে হচ্ছে ক্ষোদ প্রশাসন কর্মকর্তাদের। ১৫ জানুয়ারি (রবিবার) বেলা পৌনে ১২ টার দিকে লাকসাম পৌরসভার গাজিমুড়া দক্ষিণপাড়া মাঠে অবৈধ ড্রেজার মেশিনে বাঁধা দেওয়ায় ভূমি অফিসের তিন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কুপিয়ে আহত করেছে ভূমি দস্যুরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুমিল্লা জেলার ১৭টি উপজেলায় প্রায় আড়াইশ ইট ভাটা রয়েছে। বাংলা বর্ষপঞ্জিকার কার্তিক মাসের শুরু থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রায় ৬ মাস মাটি পরিবহন ও ইট তৈরির কাজ চালিয়ে আসছে ইটভাটার মালিকরা। ওইসব ইটভাটায় সারা বছরের মাটি জোগান দিচ্ছে এ জেলার কৃষি জমি ও অরক্ষিত 'গোমতি' নদীর সুবিশাল চর। মৌসুম জুড়ে ইটভাটায় মাটি সরবরাহে ব্যবহার করা হচ্ছে ট্রালি যুক্তি অবৈধ ট্রাক্টর ও ড্রাম ট্রাক। আর ভারি যানবাহনের চাকায় ক্ষতিগ্রস্থ সড়কগুলো যেন বালুময়।
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার কৃষকদের অভিযোগ, প্রতিনিয়ত রাতের আধারে কৃষি জমি ও গোমতী নদীর মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইটভাটায়। এ বিষয়ে বহুবার জমির মালিকদের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নেইনি প্রশাসন। ফলে উপজেলার বেশ কয়েকটি জায়গার খালের পানি নিষ্কাশন বন্ধ করে ড্রাইভেশন তৈরি করে বেপরোয়া ভাবে দিনে-রাতে কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইটভাটায়।
জেলার চান্দিনা উপজেলার পানিপাড়া এলাকার স্কুল ছাত্রী ফাহমিদা আক্তার জানান, আমাদের গ্রামে বেশ কয়েকটি ইটভাটা রয়েছে। প্রতিদিন ভোর থেকে রাত অবধি চলছে মাটির গাড়ি। কাঁদামাটি পাকা রাস্তায় পড়ে বিভিন্ন স্থানে পিচঢালা রাস্তাও দেখা যাচ্ছে না। আর মাটির রাস্তাগুলোর ধুলোতে পা দেবে যায়।
একদিন স্কুল থেকে আসলেই ড্রেস ময়লা হয়ে যাচ্ছে এমনকি মাস্ক বা নেকাব এর ভিতরেও ধুলাবালি প্রবেশ করছে। আমরা এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চাই। সম্প্রতি বুড়িচং উপজেলার মোকাম ইউনিয়নে স্থানীয় চেয়ারম্যানের উদ্যোগে আটক করা হয়েছে বেশ কয়েকটি অবৈধ ড্রেজার। চেয়ারম্যানের এমন সাহসী কর্মকাণ্ডে জেলা জুড়ে প্রশাংসার ফুলঝুড়ি।
বুড়িচং উপজেলার মোকাম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ সাহেব আলী জানান, মোকাম ইউনিয়নের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ফসলী জমি ও জলাশয়ে অবৈধ ড্রেজার মেশিন বসিয়ে কৃষি জমি থেকে গভীর গর্ত করে মাটি উত্তোলনের ফলে ফসল ও জমির ব্যপক ক্ষতি হচ্ছে। এ ধরণের অভিযোগ এলাকার অসংখ্য কৃষক করে আসছে। কৃষক ও ফসল বাঁচাতে আমি ড্রেজার মেশিন জব্দ করেছি। কৃষকদের বৃহৎ স্বার্থে আমি এলাকায় এধরণের অভিযান অব্যহৃত রাখবো।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ময়নামতি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. মুজিব রাহমান জানান, ধুলাবালিতে নানা জীবানু মানব দেহের ফুসফুসে সংক্রামণ করায় শ্বাস কষ্ট, হৃদ রোগ ও ক্যান্সার থেকে শুরু করে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটছে বায়ু দূষণের ফলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে বাংলাদেশেও বায়ূ দূষণে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। এই বায়ু দূষণে প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় সচেতন মহলকেও আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. মিজানুর রহমান জানান, কৃষি জমিতে মাটি কেটে শুধু মাটিই নিচ্ছে না। কেটে নিচ্ছে কৃষির হৃদপিন্ড। যেসব জমির টপ সয়েল কেটে নেওয়া হচ্ছে ওইসব জমিতে উর্বরতা আবার আগের অবস্থায় আসতে ২০-৫০ বছর সময় লাগে।
অনেক মুনাফা লোভী কৃষক রয়েছেন যারা মনে করছেন উপরের ২/১ ফুট মাটি বিক্রি করে কিছু টাকা পাবেন জমি তো রয়েই যাবে, ওইসব কৃষক জমির টপ সয়েলের গুরুত্ব বুঝেন না। আবার কিছু দালাল রয়েছে তারা লেখাপড়া না জানা বা স্বল্প জ্ঞান সম্পন্ন কৃষকদের ভুলভাল বুঝিয়ে বাগিয়ে নিচ্ছেন নিজেদের স্বার্থ। জমির টপ সয়েল কেটে নেওয়া বন্ধ করতে আমরা জেলা সমন্বয় সভায়ও আলোচনা করেছি। বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আমরা প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
এএজেড